আশির দশকের গোড়ার দিক থেকে কয়েক বছর আমি আর আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু সুবলকুমার বণিক আজিমপুরে একই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতাম। সেই কয়েকটি বছর আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। গভীর রাতে আমারা শুয়ে শুয়ে আড্ডা দিতাম। সাহিত্য ছাড়াও জীবনের অনেক বেদনার কথা থাকতো আমাদের দুজনের কথাতেই। আমরা খুব বেদনার্ত মানুষ ছিলাম। একদিন সুবল জানাল একটি মজার ঘটনা। আমার প্রিয় মানুষ প্রিয় শিক্ষক সেলিম আল দীনের একটি লেখার আলোচনা লিখেছিল সুবল। লেখাটি সেলিম আল দীনের পছন্দ হয়নি। এর কিছুদিন পর দেখা গেল টেলিভিশনের একটি নাটকে সেলিম আল দীন একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন গৃহ ভৃত্যের, তার নাম দিয়েছেন ‘সুবল’। বিষয়টা নিয়ে আমরা দুজনেই হেসেছিলাম, অনেক দুঃখের
মাঝেও। কাকতালীয়ভাবে একই ঘটনা ঘটে আমার ক্ষেত্রে। আমার অগ্রজপ্রতিম এক বন্ধু বাংলা একাডেমীতে চাকুরী করতেন। তাঁর কন্যা খুব মেধাবী ছিল, ঢাকা বোর্ডে মেধা তালিকায় গোড়ার দিকে ছিল। মেয়েটি হুমায়ুন আহমেদের টেলিভিশনের একটি ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে। কিন্তু কিছুদিন পর একটি বিশেষ কারণে মেয়েটি আত্মহত্যার চেষ্টা করে। বিষয়টি আমাদের জন্য খুব কষ্টের ছিল। এই ঘটনার পর থেকে হুমায়ুন আহমেদের নৈতিকতা, এমনকি তাঁর মানবিকতা সম্পর্কে আমার ধারনা বদলায়। আমি তাঁর লেখা একদম পড়া বন্ধ করে দিই। মাঝে মাঝে তিনি নিউ মার্কেটের ‘প্রগতি’তে আসতেন আড্ডায়। আমি তাঁর সঙ্গে সাহিত্য বিষয়ে তক্কাতক্কিতে লিপ্ত হই। তাঁকে আমার ভীষণ স্বল্পপঠিত মানুষ মনে হয়, কিন্তু খুব ধূর্ত এবং তির্যক
পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার অধিকারীও মনে হয়। আমার তাঁর সঙ্গে তক্কাতক্কি এবং আমার ধারালো, কিছুটা ক্ষার-মিশ্রিত জিহবা তাঁর ভাল লাগতো না সেটা বুঝতে পারতাম। সেই আড্ডায় অনেক কবি সাহিত্যিক থাকতেন, তাঁরা অনেকে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মানুষের প্রতি এই লেখকের তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা শ্রদ্ধাহীনতা আমাকে কষ্ট দিত কোন কারণ ছাড়াই! মনে হত লেখকদের কিছুটা মানবিক হওয়া জরুরি। যদিও পরে বুঝেছি সেটা ভুল, আমাদের দেশে লেখকরা জনপ্রিয় হলেই চলে। মানবিকতা তাদের না থাকলেও চলে, সবাই বিভূতিভূষণ বা মানিক হবেন না! তাছাড়া আমাদের সমাজটা খুব সংস্কৃত নয়। এই তক্কাতক্কির কিছুদিনের মধ্যেই দেখি হুমায়ুন আহমেদ তাঁর জনপ্রিয় একটি টেলিভিশন সিরিয়ালের একটি ভৃত্যের চরিত্রের নাম রেখেছেন ‘কাদের’। আমি তখন টেলিভিশনে কর্মরত। আমি আর সুবল বিষয়টা নিয়ে খুব হেসেছিলাম। ভেবেছি ভাগ্যিস ভৃত্যের নাম ‘আবেদীন’ রাখেন নি। তাহলে আমার দরিদ্র স্কুল শিক্ষক পিতার অপমানে বেশি কষ্ট পেতাম। এই হল আমাদের জনপ্রিয় লেখকদের মানসিকতা। তাদের প্রেম বা নৈতিকতা নিয়েও অনেক কথা ভাবার আছে। অনেকদিন পর আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে বিষয়টির কিছুটা উল্লেখ করেছিলাম। আমাদের জনপ্রিয় লেখকদের মনোজগৎ নিয়ে আমরা কমই জানি। আমার বন্ধু সুবল খুব মহৎ হৃদয়ের মানুষ ছিল। ওঁকে নিয়ে অনেক লেখার আছে আমার!