চিত্রপট
মুমতাজাহ্ নাওয়ার সুবহা
দশম শ্রেণি
বয়স ১৬
আমার পছন্দের কালো কফির মগটা যখন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো তখন মনটাও বুঝি কেউ হাতুড়ি দিয়ে হাজার টুকরো করে দিলো।
মগটা আমার মেয়ে নুরী মাদার্স ডে’তে gift করেছিলো। বড়সড় মগটাতে বোল্ড রাইটিং এ তার লেখা কবিতা,
“মাগো তোমার কোলে যখন এলাম
সোনামুখে আদর করে
হাসিমুখে নিলে কোলে
মাতৃস্নেহে হৃদয় ভরে।”
মগের অন্যপাশটিতে আরেকটি কবিতা,
“ভালোবেসে মা নিঃস্বার্থভাবে
কোনদিকে নাহি চেয়ে
মায়ের মত এত দরদ
দিতে পারে কে এমন করে।”
ছোট ছোট লেখাগুলো এখন মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।মগটা ভাঙলো কার হাতে? বাড়ির রুনুবুয়ার হাত থেকে পড়ে।এই মূহুর্তে বুয়া এবং আমি দুজনেই কেবল কাঁচের টুকরোর দিকে তাকিয়ে আছি। বুয়ার হাতে সাবানের ফেনা,ওপাশে সিঙ্কে আধোয়া প্লেট, পিরিচ, মগ ধুয়ে রাখতে যেয়ে সাবানের ফেনায় হাত পিছলে মগটা পড়ে যায় ।
ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে বুয়াকে কোনভাবে দোষারোপ করা যায়না,ওর জায়গায় আমিও হতে পারতাম। রুনু্বুয়া হয়তো এ মূহুর্তে আমার মনের ভাঙাচুরা পিসগুলো দেখতে পাচ্ছে এমন স্বরেই সে নত কন্ঠে কিছু একটা বলতে যায় কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে কিছুটা অবাক করে দিয়ে বলি,
“সমস্যা নাই খালা,ভাঙা টুকরো গুলো সাবধানে কুড়িয়ে বিন এ ফেলে দাও।”
ভেবেছিলাম সে কিছুটা অবাক হবে,নাহ্ অনেক বেশিই অবাক হলো । বিস্ময়ে চোখের মনি বেরিয়ে পড়বে এমন অবস্থা ।মগের ভাঙা পিসগুলো নাহয় বুয়া সরালো, আমার মনের ভাঙা টুকরোগুলো কে উঠাবে? কবিতার শব্দগুলো ক্রমাগত মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে । চোখদুটো হঠাৎ জ্বালা করে উঠলো আমার।
নুরীর দেয়া মগ ভাঙার পর মানহার সাদা সিরামিকের মগটা বের করলাম । প্রাগ থেকে একবছর আগে আমার স্কুল জীবনের বন্ধুটি এনেছিলো । এ মগটাতে বিশেষ কিছু নেই শুধু কিছু ছোটবড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছাড়া।
সেই চিহ্নগুলোর দিকে তাকালেই অজানা ভয়ে বুকটা ধক করে ওঠে । এই চিহ্ন যেন সর্বক্ষন চলা ফেরা, উঠাবসা, কাজকর্ম, জীবনযাপন, চরিত্র সবকিছুর উপর এক বিরাট প্রশ্ন। সেই প্রশ্নবোধক চিহ্নের দিকে তাকালে মনে হয় তারা আমাকে জিজ্ঞেস করছে,
“তুমি আমাদের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
“তাকিয়ে থাকলে তোমার কি?” আমিও বলতে থাকি মনে মনে।
“প্রশ্ন করার অধিকার আমাদের আছে,তোমার নেই।”
আমি আহত গলায় বলি,
“ঠিক আছে।”
তারা সবাই একসাথে বলে উঠে,
“তুমি এই অদ্ভুত সময়ে কফি খাচ্ছো কেন?”
“অদ্ভুদ সময় ? সন্ধ্যা ৭টা বাজে, সবাই এসময়েই কফি খায়।”
“তোমাাকে এ সময়েই কেন খেতে হবে?”
“আমার ইচ্ছা”
“তোমার ইচ্ছা হবে কেন?”
“আরে, ভারী ঝামেলা তো।”
” এত ঝামেলা ঝামেলা করো কেন?”
নিজেই হেসে উঠলাম ।
নিজের সাথে কথা বলাটা বেশ মজার একটা খেলা । এটা প্রায়ই আমি নিজের সাথে করি । ভালো সময় কাটে,মন ভালো হয়ে যায়। একাকী মনে হয়না তখন
।
ক্লাশ টেন অবধি English Grammer আমার জীবন পুরো তছনছ করে দিয়েছিলো । টেন্স,ন্যারেশান,ভয়েস চেঞ্জ,ডিগ্রী কিছুতেই মাথায় ঢুকতোনা । বিশেষ করে ছোটবেলায যখন পাংচুয়েশান শেখাতে গিয়ে সেই রাগী ম্যাডাম, কি যেন নাম……ও, হ্যাঁ, রুবিনা মিস,উনার শাস্তি যারা পেয়েছে উনাকে কেউ হয়তো এখনো ভুলেনি।
তখন প্রতিবার সেন্টেন্স শেষে (?) মার্ক দিতে ভুলে যেতাম, আসলেই ভুলে যেতাম নাকি ইচ্ছে করেই দিতামনা কে জানে?
তখনকার সময়ে স্কুল,কলেজে এত সিস্টেম ছিলোনা, স্যার,ম্যাডামরা সামান্য থেকে সামান্য বিষয়েই দমাদম বেতের বাড়ি লাগিয়ে দিতেন ।
এই ইংরেজী গ্রামারের জন্য সে বাড়ি যখন তেলতেলে নরম হাতের উপর কড়াশ করে পড়তো তখন কিভাবে যে দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম ভাবলে এখনো হাতটা জ্বলে উঠে ।
ক্লাশে সবার তখন ব্লাড সার্কুলেশান বন্ধ হয়ে যেতো, হয়তো ভয়ে সবাই নিঃম্বাস বন্ধ করে রাখতো ।
শুধু ইংরেজীর জন্য আমি একাই মার খেতাম, গ্রামারের দূর্বলতা ছিলো আমার।
রফিক খেতো গণিতের সূত্র ভুলে গিয়ে, সিয়াম বাংলা বানান ভুল করতো, আফিফা ধর্মের আয়াত ভুলে যেতো ।
আরো অনেকে ছিলো, যার যার বিষয়ের দূর্বলতার জন্য শাস্তি পেতো। সবার কথা স্মৃতিতে নেই ।
ইংরেজীতে ফেল করা নিয়ে আমার আব্বা আম্মার তখন তেমন মাথা ঘামানোও ছিলোনা । ওনাদের কথা উপরের ক্লাশে উঠতে উঠতে ঠিক হয়ে যাবে ।
এরপর যখন সবাই এস,এস,সির প্রস্তুতি নিচ্ছিলো তখন আমি পাগলের মত ন্যারেশান রুলগুলো মুখস্ত করতাম, কিন্তু মাথায় কিছুই ঢুকতোনা ।
আজ অবধি parts of speech নিয়ে কিছুটা গোলমাল রয়েই গেছে মনে হয় ।
সেইসময় স্কুল কলেজের রাজ্যের সব গ্রামার বই,গাইড,টেস্টপেপার বাসায় পড়ে থাকতে থাকতে যখন ইমারত গড়ে উঠতো মা উপায় না পেয়ে পেপার বিক্রেতার কাছে বেচে দিতেন ।
দাম দিয়ে এত এত বই কিনা থাকলেও সে সময় বইগুলো বিক্রি করে বিশ ত্রিশ টাকার বেশি উঠতোনা দেখে রাগে, ক্ষোভে গা জ্বলতো ।
পড়াশোনার এহেন নাজুক অবস্থা দেখে কোনমতে এস এস সি টা পাশ করার জন্য কোথা থেকে যেন আব্বা একজন হোম টিউটর ঠিক করে দেন, এবং সেই মুশফিক স্যারের কল্যানেই হয়তো এস এস সিটা পাশ করেছিলাম।
আত্মীয় স্বজনেরা ভেবেছেলো মিরাজ ভাইয়ের গাধা মেয়েটা বোধহয় ম্যাট্রিকটা পার হতে পারবেনা, দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করাতে তাদের মুখে তালা লেগে গিয়েছিলো । পড়াশোনা নিয়ে তারা এরপর আর মুখ খুলেনি কখনো ।
ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে উঠে ডাক্তারীপড়ার এক দারুন শখ জেগে উঠেছিলো ।
তখনকার দিনে পাড়া বা আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কেউ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হলে বাড়ির সবাই তাকে মাথায় তুলে রাখতো, কতরকম খাতির, নামডাক! ইশ, ওসব দেখে আমার ভীষন ইচ্ছে হতো।
আমিও মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম,Gynacology @ Obstritics নিয়ে পড়বো কিন্তু এইচ এস সির কাছাকাছি আসতেই প্র্যাকটিক্যালে যখন ব্যাঙ কাটতে বলা হলো তখন সারা শরীর ভয়ে শিউরে উঠেছিলো ।
আমার মনে আছে সেইদিন অনেক ছাত্র ছাত্রী মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলো ।
ভাবছিলাম মরা ব্যাঙ দেখে কেমনে কি হলো জানিনা তবে বমি করে পুরো ল্যাব ভাসিয়ে দিয়েছিলাম ।
সে মূহুর্তে ক্লাসমেট মেহবুবা সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলো,
“আরে মেয়ে,তোমাকে ব্যাঙ কাটতে বলেছে, খেতে তো বলেনি,খেতে বললে একটা কথা ছিলো।”
ব্যাঙ খাওয়ার কথাটা চিন্তা করে আমি তখন গলগল করে আরো বমি করা শুরু করেছিলাম । তখনি আমার মাথা থেকে ডাক্তার হওয়ার ঝোঁক বেলুন ফেটে বাতাস বের হওয়ার মত বেরিয়ে গেলো ।
সেই মেহবুবাও আজ ডাক্তার ।
আমার ক্যারিয়ার নিয়ে আমি বড্ড কনফিউজড্ ছিলাম ।
এর মধ্যে চাচা মামারা এক একজন এক এক কথা বলে মাথা আরো নষ্ট করতো তখন। কেউ বলতো ব্যাঙ্কার হতে, কেউবা এডভোকেট, আবার কেউ বিসিএস অফিসার হতে বলতো ।
কেউ আবার বলতো চাকরী বাকরীর চিন্তা ছাড়ো, বিয়ে করে ফেলো ।
কেউ কি তখন জানতো সেই ইংরেজীতে ফেল করা মেয়ে আজ ইংরেজীর টিচার………।