দেশে থাকতে আমার ভীষণ ‘টাই’ প্রীতি ছিল। মানে কোট প্যান্ট ড্রেস শার্ট ড্রেস স্যু এর সাথে সুন্দর একটা টাই পরতে পারলে নিজেকে মনে হত ভীষণ অভিজাত, এলিগ্যান্ট উঁচু শ্রেণীর কেউ। তখন মনে হত মাটিতে পা নাই, শূন্যে উঠে গেছে। এমন দেখে বড় হয়েছি কিনা !
কামালের সাথে আশি সালে কলকাতায় গেলাম জিন্স পরে। আর কামাল পড়লো কমপ্লিট স্যুট টাই। ওকে দেখে নিজের জন্য খুব করুনা হচ্ছিলো। নিজের টাই কোট ছিল না বলে দুঃখে কইলজা ফেটে গেছিলো।
পড়াশুনা শেষে প্রথম চাকরিতে জয়েন করে ওদের নিয়ম মোতাবেক অমন কেতা দুরস্ত পোষাক পরে অফিসে যেতাম। আর ভাবতাম আমি কি হনু রে।
আমেরিকায় রওয়ানা দিয়েছিলাম কোট টাই পরে। সস্তা টিকিটে অনেক দেশ ঘুরে নিউইয়র্কে এসে পৌঁছুতে ২/৩ দিন লেগে গেলো। বিভিন্ন এয়ারপোর্টে, বিভিন্ন প্লেনের চিপা সিটে বসে থাকতে থাকতে আর এসব পরে খেতে গিয়ে খাবার লেগে আমার কোট টাই নোংরা হয়ে, কুঁচকে দেখতে যাচ্ছেতাই হয়ে গেছিলো। উলুখাগড়ার মত মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুলের বোঝা নিয়ে ঝড়ো কাক হয়ে যখন জেএফকে’তে নেমেছি ,আয়নায় নিজেকে দেখলে হয়ত নিজে চমকে যেতাম। আমি তো আর নিজেকে দেখতে পাই নাই। উল্টা ভেবেছি আমার কেতাদুরস্ত সাহেবি পোশাক দেখে ইমিগ্রেশন অফিসার আলগা খাতির করবে। আদতে একদম এক ফোটা পাত্তা দেয় নাই।
আমেরিকায় আসলাম। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হল। এবার দরকার একটা ডিসেন্ট জব। ডিসেন্ট জব মানে বুঝতাম কোট টাই পরে সুন্দর কাঁচঘেরা রুমে রিভলভিং চেয়ারে বসে সামনে সেক্রেটারিয়েট টেবিল নিয়ে করার কোন কাজ।
মানে অফিশিয়াল কাজ। মনে মনে অমন কিছু করার এরাদা আমার।
খেয়াল করলাম বন্ধুদের কয়েকজন তাদের কাজ শেষে অমন টাই কোট পরে বাসায় আসে আড্ডা দিতে। আমি ওদের কাছে নিজের মনের সুপ্ত আশা ব্যক্ত করি। শুনে ওরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়। বলে ধুর ব্যাটা, টাই কোটে পয়সা নাই। এসব শুধু দেখতেই সুন্দর। ভেবেছি ওরা আমাকে অমন কিছু পেতে হেল্প না করার জন্য এসব বলছে। মন খারাপ করতাম। কয়দিন পর দেখি আমার টাই পরে কাজ করা বন্ধুরা ট্যাক্সি চালানোর লাইসেন্স পেয়ে টাই ফেলে জিন্স টিশার্ট পরে গাড়ি চালানো শুরু করে দিয়েছে। ট্যাক্সিতে অনেক ভাল রোজগার হয়।
আমার আর টাই পরা হল না। মনের দুঃখে টাই কোট না পরে জিন্স স্নিকার পরে কাজে যাই। কাজ মানে অড জব।
অনেক পরে যখন টাই পরে কাজ করার সুযোগ এলো তখন আমার আর আগ্রহ ছিল না। তদ্দিনে আমি ব্যবসায়ী। নিজের ব্যবসায় নিজে বস, তাই চাইলেই টাই পরে অফিস রুমে বসে কর্মচারীদের হুকুম দিতে পারতাম। কিন্তু এদেশে এভাবে যে কেউ কাজ করে না। কাজ আদায় করতে হলে শার্টের হাত গুটিয়ে নিজেকেও কাজ নামতে হয় অন্যদের পাশাপাশি। শুধু তাইলেই অধীনস্তদের সমীহ আদায় করা সম্ভব। নইলে সব ফাঁকিবাজির কাজ হবে।
তাইলে টাই কি আর আমার পরা হল না ?
আরে বলেন কি, তা হবে না কেন !
কত সুন্দর সুন্দর টাই কোট কিনেছি শখ করে। যখন কোন বিয়ে শাদী, বার্থডে, মিলাদ, এনিভার্সারি, পুনর্মিলনী। পিকনিক ইত্যাদির দাওয়াত পাই, তখন টাই কোট পরি। খেতে গিয়ে কত জনের টাইতে ঝোল লেগে গড়িয়ে পড়তে দেখলাম।
টাই পরে আমাদের সেকেলে মাথায় গেঁথে থাকা অন্তিম সুখ উপভোগ করি।
তবে এসব পরি শুধু স্বদেশি অনুষ্ঠান।
এদেশীয় অনুষ্ঠানে খুব ফর্মাল ড্রেস কোডের বাধ্যকতা না থাকলে যে যার খুশি মত কাপড় পরে আসে। আমার শ্বেতাঙ্গ বিজনেস পার্টনারের বিয়ে যাওয়ার জন্য আমি স্যুট কিনলাম। শেফালীও এদেশীয় ফর্মাল ড্রেস কিনলো। খুব দামী জায়গায় বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। পোলাটা আমারে অবাক করে দিয়ে বলে – মুরাদ, শোন – তোমার বউকে বলবা তোমাদের দেশীয় কাস্টোমারী শাড়ি পরতে। আর তুমি সাদা হাওয়াই শার্ট পরবে। নো টাই।
সামার ছিল। বিয়েটা হয়েছে একটা রেস্ট্রিকট্রেড বিচে, আর অনুষ্ঠান, ডিনার পাশের একটা গার্ডেনে। এত সুন্দর সুন্দর মানুষ অতিথি হয়ে এসেছে কিন্তু কেউ স্যুট টাই পরে নাই। আর সব মহিলাদের ভিতর একমাত্র শেফালী শাড়ি পরে যাওয়ায় সবার কৌতূহল ছিল তাকে নিয়ে।
আমি কি ভাইবা কি স্বপ্ন দেইখা বৈদেশে আইলাম আর বৈদেশ আমারে পুরা বদলায়া, আমার মনের ভিতর গেঁড়ে থাকা ভীত নড়ায়া দিয়া আমারে ভিন্ন মানুষ বানায়া লাটিমের মতন ছাইড়া দিলো বাজারে।