আকবর হায়দার কিরন
কেউ কেউ রসিকতা করে বলে, “আপনি কি মানুষ একজন না কি একাধিক আর এতো রকমের কাজ করলেন কখন, করার আর কি কিছু বাকি আছে!” বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনের ম্যাটার্নিটিতে জন্ম গ্রহণের পর ওনার মাতা-পিতা যখন ওনাকে নিয়ে নোয়াখালীর ভীমপুর-এর (চাটখিল) বাড়িতে আসেন তখন বয়স তাঁর ছিলো সাড়ে তিন বছরের মতো। ওনার আব্বার পোস্টিং হলো মাইজদীতে, সেই সুবাদে ভর্তি করালেন কল্যাণ স্কুলে ক্লাশ থ্রীতে। কয়েক মাস পর নিয়ে গেলেন আবার গ্রামে, ভর্তি করালেন আবু তোরাব নগর ফ্রী প্রাইমারী স্কুলে। সেখান থেকে চাটখিল হাই স্কুলে ক্লাশ ফাইভে। ওখান থেকে চাটখিল কলেজে। কলেজে থাকাকালে ছিলেন একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাপতি, পাশাপাশি ছিলো ঔষধের ব্যবসা। কিন্তু কাজের কাজ হয় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড এবং কবিতা ও নিউজ লিখে পত্রিকায় প্রেরণ আর সাহিত্য বিষয়ক
ম্যাগাজিন ছাপানো। ডিগ্রী পরীক্ষার পর কয়েক মাস শিক্ষকতা করলেন ভীমপুর হাইস্কুলে। এরপর ঘরসংসার, ব্যাবসা-বাণিজ্য সব ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপরের ইতিহাস অনেকটাই স্পষ্ট। চার দশকেরও বেশি সময় সংবাদ জগতে বিচরণ। এর মধ্যে কতো বিচিত্র কর্মের সাথে জড়িয়ে গেছেন, ভাবাই যায়না। তিনি বলেন, আমিতো ভাই কিছুই করিনি, জীবন আমাকে নিয়ে দাবা খেলেছে, যখন যেখানে রেখেছে জীবন-দাবার চালের অংশ হিসেবে তখন সেখানে কিছু একটা দৃশ্যমান হয়েছে। আমরা কথা বলে দেখেছি, ওনার সাথে উঠাবসা করে দেখেছি, ভেতরে একটি সরল-সোজা মন রয়েছে তাঁর। এই ভদ্রলোককে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকা বিস্তারিত নিউজ করেছে। আমরা সেরকম তিনটা পত্রিকার রিপোর্ট সমন্বয় করে একটা পরিপূর্ণ চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
এতোক্ষণ যাঁর কথা বললাম ওনার নাম মাইন উদ্দিন আহমেদ। একটা ডাকনাম আছে, তা হলো, সেলিম। ছাত্রজীবনে তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন, কবিতা লিখতেন, নাটক করতেন। তখন এসব খবর এবং স্বরচিত কবিতা পাঠাতেন বিভিন্ন পত্রিকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত অবস্থায় ‘সচিত্র অবয়ব’ নামক একটি মাগ্যাজিনে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতা শুরু করেন ১৯৮১ তে। চাকুরি হিসেবে সাংবাদিকতাকে গ্রহণ করেন বাংলাদেশ অবজারভার পত্রিকার মাধ্যমে। কাজ করেন মর্নিং সান, নিউ নেশনে। দি ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় কাজ করেছেন উনিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। দৈনিক দিনকালের সম্পাদকীয় বিভাগেও বছর খানেক কাজ করেছেন।
সততার সাথে সাংবাদিকতা করার জন্য তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন অনেক বার। প্রথমে নোয়াখালীর চাটখিল প্রেসক্লাব তাকে সম্মাননা প্রদান করেন। পরবর্তীতে আরো যে সব প্রতিষ্ঠান মাইন উদ্দিন আহমেদকে সম্মাননা প্রদান করেন, তার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ কল্যাণ সোসাইটি, বাংলাদেশ প্রতারণা প্রতিরোধ সোসাইটি, হিউম্যান রাইটস রিভিউ সোসাইটি, বাংলাদেশ নির্যাতন প্রতিরোধ সোসাইটি ইত্যাদি।
মাইন উদ্দিন আহমেদ এমনই একজন ভাগ্যবান ব্যক্তি যিনি স্কুলে অধ্যয়নরত অবস্থায় তার পিতার সংগ্রহশালায় পেয়েছেন অনেকগুলো মাসিক মোহাম্মদী এবং তার পিতার হস্তলিখিত কিছু গদ্য-পদ্য। পরবর্তীকালে যাঁরা বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্র হয়ে উঠেছেন তাঁদের অনেকেরই লেখা থাকতো মোহাম্মদী পত্রিকায়। এরকম একটি অবস্থা তাকে লেখক হবার জন্য উৎসাহী করে তোলে। কলেজে থাকতেই রাতারাতি কবি হবার জন্য ট্রেডল মেশিনে ছেপে নেন স্বরচিত কবিতার বই ‘পদভারে জাগ্রত সিঁড়ি’। সাংবাদিকতা করার ভেতর ফাঁকে ফাঁকে গল্পও লিখতে থাকেন। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয় গল্পের বই ‘অন্যত্র চলো’। আঞ্চলিক ভাষায় ছড়ার বই লেখেন ‘গোমর ওইলো হাক’। ২০১০-এ বাংলা একাডেমীর বই মেলায় তার কবিতার বই ‘পরাবাস্তবতা’ নিয়ে আসে মিজান পাবলিশার্স। এরই মধ্যে তরুণ বন্ধুরা প্রকাশ করে তার কবিতা আবৃত্তির সিডি ‘চন্দ্র বিষয়ক জটিলতা’। বছর চারেক কবিতা আবৃত্তি শেখান জাতীয় প্রেসক্লাব সদস্যবৃন্দের সন্তানদেরকে। প্রেসক্লাব সদস্য কবিদের মূখপত্র কবিতাপত্র-এর সম্পাদনা পরিষদের একজন সদস্য মাইন উদ্দিন আহমেদ। দিনকাল পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় হিসেবে মুদ্রিত লেখাগুলো নিয়ে তিনি দু/একটা বই ছাপাতে চান।
কাব্যক্ষেত্রে মাইন উদ্দিন আহমেদ-এর বিচরণ বিশ্বজনিন হয়ে ওঠে যখন তিনি আমেরিকার লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস নামে খ্যাত প্রতিষ্ঠানের কবিতার ওয়েবসাইট পোয়েট্রিডটকম-এ কবিতা পাঠাতে শুরু করেন। অত্র প্রতিষ্ঠান তাকে ২০০৭-এ ‘পোয়েট্রি মানথ এম্ব্যাসাডর’ মনোনীত করেন। তার অনেক কবিতা ঐ বছরই ‘এডিটরস চয়েজ এওয়ার্ড’ লাভ করে। সেখানে তার প্রায় একশত ইংরেজি কবিতা রয়েছে ওদেও আর্কাইভে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, মালিকানার কোন্দলে এখন ঐ কবিতাগুলো ওয়েবসাইটে পাওয়া যাচ্ছেনা, এই অবস্হাকে তিনি আন্তর্জাতিক কপিরাইট আইনের বিরোধী বলে মনে করেন। অবশ্য এরই মধ্যে ওখানকার অনেকগুলো কবিতা পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছে তরফদার প্রকাশনী, ‘লভ ইজ সফ্টঅয়্যার বন্ডেজ’ নামে, ২০২০ সালে।
এছাড়া লাভিংইউডটকম, পোয়েমহান্টার, পোয়েমসঅনলি, পোয়েটস এগেইনস্ট ওয়ার প্রভৃতি ওয়েবসাইটে মাইন উদ্দিন আহমেদের অসংখ্য কবিতা রয়েছে। ওনার একটা ফেইসবুক একাউন্ট হ্যাক হয়ে যাওয়াতে তিনি তাঁর বহুল ব্যবহৃত ইমেইল আর ব্যবহার করতে পারেননি এবং একারনে অনেকগুলো ওয়েবসাইটে তিনি ঢুকতে পারছেননা বলে আক্ষেপ করছেন।
ওয়েলকামপোয়েট্রি (ওয়েব ফর পোয়েটস) নামের একটি কবিতার ওয়েবসাইট সম্পাদনা করেছেন তিনি। বাংলাদেশ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাহিত্য পদক পেয়েছেন তিনি। আবৃত্তি করেন চমৎকার।
সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিক ছাড়াও মাইন উদ্দিন আহমেদ-এর আরেকটি পরিচয় আছে। তিনি একজন মার্শাল আর্টিস্ট। মার্শালস গার্ডেন নামক একটি প্রতিষ্ঠান তিনি চেয়ারম্যান ও প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে বহু বছর পরিচালনা করেছেন। প্রশিক্ষণের সময় তিনি তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদেও ইংরেজিতে কথা বলায় উৎসাহিত করতেন। তিনি মার্শাল আর্ট শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন ছল্লিশ বছর বয়সে, চার বছরেরও বেশি সময় কঠিন সাধনা করে ব্ল্যাক বেল্ট লাভ করেন। তিনি ওয়ার্ল্ড ইউনিয়ন অফ কারাতে-দো অর্গানাইজেশনস-এর একজন সদস্য। চর্চা করেন সোতোকান স্টাইলের কারাতে। সম্মাননা ও সনদ পেয়েছেন তাইচী কারাতে একাডেমী এবং বাংলাদেশ কারাতে দো-এর এবং ওয়ার্ল্ড ইউনিয়ন অফ কারাতে-দো অর্গানাইজেশনের।
মাইন উদ্দিন আহমেদ-এর নাট্যক্ষেত্রে বিচরণ ছাত্রজীবন থেকে। স্কুল ও কলেজের অনেক নাটকে তিনি সুনামের সাথে অভিনয় করেছেন। চাকুরি জীবনের প্রচুর ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি নাটককে ভুলতে পারেন নি। ১৯৯৬ সনে বিটিভির একটি নাটকেও কাজ করেছেন। চ্যানেল আই-এর সিরিজ নাটক ‘ছায়াবীথি’-তে একটি চরিত্রের নীরব দুঃখ ফুটিয়ে তোলেন তিনি। তাছাড়া আরো অন্যান্য নাটক ও মিউজিক ভিডিওতেও অভিনয় করেন।
তিনি ইংরেজি নিউজ সম্পাদনা প্রশিক্ষণ প্রদানেও নিয়োজিত ছিলেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ জার্ণালিজম এন্ড ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় তিনি নিউজ এডিটিং এবং গণসংযোগের উপর ক্লাশ নিতেন।
মাইন উদ্দিন আহমেদকে একজন সমবায়ীও বটে। দীর্ঘদিন সম্প্রীতি সমবায় সমিতি লিঃ এর সভাপতি ছিলেন। সভাপতি থাকাকালে সমিতির নির্ধারিত কাজের বাইরেও তিনি সমাজকল্যামূলক কাজ করেছেন। সমিতিকে জাতীয় স্বাস্থ্য সেবামূলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে যথেষ্ট বাহবা কুড়িয়েছেন।
মানবকল্যাণমূলক সংগঠন আবদুল্লাহ সাহেব স্মৃতি সংসদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি বিভিন্ন জাতীয় দিবসে কবিতা আবৃত্তি, চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, বক্তৃতা চর্চা প্রভৃতি আয়োজন করেন। এগুলোতে তিনি উৎসাহ দেয়ার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখেন।
স্কুল ও কলেজে পাঠরত সময়ে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও নাট্য অঙ্গনে তার সম্পৃক্ততা এখনো সবাই খুশি ও শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করে। তিনি একাধিকবার ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত নির্বাহী পরিষদের সদস্য এবং বিএফইউজের কাউন্সিলর ছিলেন। একনিষ্ঠ এবং সৎকর্মী মাইন উদ্দিন আহমেদ বিশ্রী ধরনের দালালি বা পিঠ চুলকানি পছন্দ করেন না। তাই পেশাগত জীবনে তিনি স্বাধীনচেতা।
তিনি ঢাকা সাংবাদিক সমবায় সমিতি লিঃ-এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
দি ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকায় দীর্ঘ উনিশ বছরেরও বেশি সময় সাংবাদিকতা করার পর তিনি সম্পাদক ও প্রকাশক হিসেবে ইংলিশনিউজবিডিডটকম নামক একটি নিউজ পোর্টাল চালান দুবছরেরও বেশি সময় ধরে। এরপর তিনি ডেইলী দি এশিয়ান এইজ পত্রিকায় মেট্রো ইন চার্জ হিসেবে যোগদান করেন। বছর খানেকের মধ্যে তিনি প্রমোশান পেয়ে এসিস্ট্যান্ট এডিটর হন। একই পত্রিকার নিউ ইয়র্ক সংবাদদাতা হিসেবে তিনি ২০১৮-এর শেষ দিকে কাজ শুরু করেন এবং ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কাজ করছেন। নিউ ইয়র্কের ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘কথার কথকতা’ শিরোনামে একটি কলাম লেখেন এবং নিউইয়র্কবাংলাডটকম নিউজ ওয়েবসাইটে কন্ট্রিবিউট করেন। এছাড়াও মাইন উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ ও আমেরিকায় বিভিন্ন নিউজ পোর্টাল, আইপি টিভি এবং মানবিক সংগঠনে উপদেষ্টা হিসেবে অনরারী সার্ভিস দিয়ে থাকেন। তিনি আমৃত্যু বিশ্বমানবতার কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখার ইচ্ছা পোষণ করেন।