মাওলানা হাসরত মোহানি ১৮৭৫ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের উননাও জিলার ‘মোহান’ নামে এক ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা ইরানের নিশাপুর থেকে ভারতে এসে মোহানে বসতি স্থান করেছিলেন। তাঁর পুরো নাম সাইয়িদ ফজল-উল-হাসান। কবি হিসেবে তিনি হাসরত (আকাঙ্খা) ও তাঁর শহরের নাম যোগ করায় ‘হাসরত মোহানি’ নামেই খ্যাতি লাভ করেছেন। ‘মাওলানা’ যুক্ত হয় সম্মানসূচক উপাধি হিসেবে। তিনি তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন এলাকার এক মাদ্রাসায়। ১৮৯৪ সালে মোহান মিডল স্কুল থেকে পরীক্ষায় পুরো রাজ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। হাইস্কুলের পড়াশোনা শেষ করে আলীগড়ে মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজে ভর্তি হন, যে প্রতিষ্ঠান পরবর্তীতে আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়ার কারণে একাধিকবার তাঁর পড়াশোনা ব্যাহত হয়। ১৯০৩ সালে তিনি বি এ ডিগ্রি লাভ করেন। রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের পাশাপাশি তিনি আলীগড় থেকে ‘উর্দু-এ-মুয়াল্লা’ নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। ১৯০৪ সালে তিনি বোম্বেতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দেন। তিনি কংগ্রেস নেতা বাল গঙ্গাধর তিলকের ভক্ত ছিলেন। ১৯০৭ সালে তিলক কংগ্রেস ত্যাগ করলে মাওলানা হাসরত মোহানিও কংগ্রেস ত্যাগ করেন। ১৯০৮ সালে তাঁর সংবাদপত্রে মিশরে ব্রিটিশ নীতির সমালোচনা করে নিবন্ধ প্রকাশ করায় তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯১৬ সালে তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হলে তিনি ব্রিটিশ আদেশ পালনে অস্বীকার করেন এবং তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তাঁর সংবাদপত্রকে বিপুল অংকের জরিমানা করা হয়। জরিমানা পরিশোধে ব্যর্থ হলে পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তিনি ‘তাজকিরাতুশ শু’রা’ নামে আরেকটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। ব্রিটিশ বিরোধী প্রকাশনার অভিযোগে ১৯২২ সালে তিনি পুনরায় কারাদণ্ড লাভ করেন।
১৯১৯ সালে মাওলানা হাসরত মোহানি মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯২১ সালে মুসলিম লীগ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবী তোলেন এবং ভারতকে ‘ইউনাইটেড স্টেটস অফ ইন্ডিয়া’ নামে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণার আহবান জানান। তাঁর ভাষণ বাজেয়াপ্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণায় সহযোগিতার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু উচ্চতর আদালত তাকে নির্দোষ বলে রায় দেয়।
মাওলানা হাসরত মোহানি ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ছিলেন। কিন্তু কমিউস্টি ভাবধারা তাঁকে তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত করেনি। ১৯২৩ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ভারতের মুসলমানদের রাজনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে আন্দোলন করলেও অবিভক্ত ভারতে বিশ্বাসী ছিলেন। সে কারণে মুসলিম লীগ পাকিস্তান দাবী করলে মুসলিম লীগের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শিথিল হয়ে পড়ে, যদিও তিনি মুসলিম লীগের মনোনয়নের ১৯৪৫ সালে ইউনাইটেড প্রভিন্স (বর্তমান উত্তর প্রদেশ) অ্যাসেম্বলির সদস্য ও ভারতের গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ভারত বিভক্ত হওয়ার পর তিনি পাকিস্তানে না গিয়ে ভারতেই অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেন। ভারতের সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর গণপরিষদ সদস্য হিসেবে একমাত্র তিনিই সংবিধানের পক্ষে ভোট দেননি, কারণ তার মতে সংবিধানে মুসলিম নাগরিকদের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে।
রাজনীতির বাইরে মাওলানা হাসরত মোহানির ভালোবাস ছিল উদর্ৃু সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতায়। তিনি রোমান্টিক কবিতার জন্য বিখ্যাত। কবিতার ওপর তাঁর অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। কবিতার ক্ষেত্রে তাঁর ওস্তাদ ছিলেন খ্যাতিমান উর্দু কবি তসলিম, মোমিন খান মোমিন ও নাসিম দেহলভি। কবিতাকে তিনি জীবনের আয়নায় পরিণত করেছিলেন। প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সমসাময়িক কবিদের চেয়ে সাহসী ছিলেন। কবিতায় তিনি আবেগ ও ভাবনাকে আড়াল করে রাখেননি। তাঁর জনপ্রিয় গজলটির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। গোলাম আলীর গাওয়া গজলে তিনি কিছু শব্দ যোগ করেছেন। পাঠকদের জন্য হাসরত মোহানির মূল গজলটি উপস্থাপন করছি:
“চুপকে চুপকে রাত দিন আসুঁ বাহানা ইয়াদ হ্যায়
হাম কো আব তক আশিকী কা ও জমানা ইয়াদ হ্যায়।
তুঝসে মিলতে হি ওহ কুচ বেবাক হো জানা মেরা
আওর তেরা দা’তোঁ মে ওহ উঙলি দাবানা ইয়াদ হ্যায়
হাম কো আব তক আশিকী কা ও জমানা ইয়াদ হ্যায়।
খেঁচ লো ও মেরা পরদে কা কোনা দাফতাঁ
আওর দোপাট্টে সে তেরা ও মুঁহ ছুপানা ইয়াদ হ্যায়।
দো-পহর কী ধূপ মে মেরে বুলানে কে লিয়ে
ও তোরা কোঠে পে নাঙ্গে পাওঁ আনা ইয়াদ হ্যায়।
তুঝ কো জব তানহা কভি পা’না তো আজ রাহে-লিহাজ
হাল-এ-দিল বাতো হী বাতো মে জাতানা ইয়াদ হ্যায়
আ গয়া গর ওসল কী শব ভি কাহিঁ জিকর-এ-ফিরাগ
ও তেরা রো রো কে ভি মুঝকো রুলানা ইয়াদ হ্যায়।
বে রুখি কে সাত সুনানা দর্দ-এ-দিল কি দাস্তান
ও কালাই মে তেরা কঙ্গন ঘুমানা ইয়াদ হ্যায়।
ওয়াক্ত-এ-রুখসত আলবিদা কা লফজ কেহনে কে লিয়ে
ও তেরে সুখে লবো কা থর-থরানা ইয়াদ হ্যায়।
আ’হাজারাঁ ইজতিরাব-ও-সদ হাজারাঁ ইশাতিয়াক
তুঝসে ও পহলে পহল দিল কা লাগানা ইয়াদ হ্যায়।
জান কর ছোতা তুঝে ও কাসা-এ-পাবসি মেরা
আওর তেরা ঠুকারা কে সর ও মুস্কুরানা ইয়াদ হ্যায়।
জব সিবা মেরে তুমহারা কোঈ দিওয়ানা না থা
সাচ কাহো ক্যায়া তুম কো ভি ও কারখানা ইয়াদ হ্যায়।
গায়ের কি নজরো সে বাচকর সব মরজি কে খিলাফ
ও তেরা চোরি ছিপে রাতোঁ কো আ’না ইয়াদ হ্যায়।
এখানা মুঝকো জো বারগাশতা তো সো সো নাজ সে
জব মেরা লেনা তো ফির খুদ রুথ জানা ইয়াদ হ্যায়।
চোরি চোরি হাম সে তুম আ কর মিলে থে জিস জাগাহ
মুদ্দতেঁ গুজারিঁ পর আব তক ও ঠিকানা ইয়াদ হ্যায়।
বাওয়াজুদ-এ-ইদ্দা-এ-ইত্তাক্কা হাসরত মুঝে
আজ তক আহাদ-এ-হাওয়াস কা ইয়ে ফাসানা ইয়াদ হ্যায়।
রাত দিন নীরবে তোমার অশ্রু বিসর্জনের কথা আমার মনে আছে
এখনও তোমার প্রেমে পড়ার দিনগুলোর কথা আমার মনে আছে।
তোমার সাথে দেখা হলে আমি সাহস হারিয়ে ফেলতাম,
তুমি তোমার দাতে আঙুল কামড়াতে তাও আমার মনে আছে।
আমি হঠাৎ করে পর্দার এক কোণা তুলে ধরতাম
আর তুমি ওড়নায় মুখ লুকাতে তা আমার মনে আছে।
তুমি দুপুরের রোদে আমাকে ডাকার জন্য,
খালি পায়ে আঙিনায় আসতে সে কথা আমার মনে আছে
আমি একা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলে আমিার লজ্জিতভাবে
কথায় কথায় আমার হৃদয়ের কথা বলার উপায় বের করতাম,
আমাদের প্রণয়ের রাতে কখনও বিদায়ের কথা ওঠলে
তুমি কীভাবে কাঁদতে এবং আমাকে কাঁদাতে তা আমার মনে আছে।
মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তুমি আমার হৃদয়ের ব্যথার কাহিনি শুনতে
আমার মনে আছে কীভাবে তুমি তোমার হাতের চুড়িগুলো ঘোরাতে।
যথন বিদায়ের বাণী উচ্চারণ করা সময় হতো
তোমার শুকনো ঠোঁট কীভাবে কেঁপে ওঠতো তা আমার মনে আছে।
হাজারটি উদ্বেগ এবং হাজারটি আকাংখা নিয়ে
কীভাবে তোমার কাছে প্রথম হৃদয় হারিয়েছিলাম তা আমার মনে আছে।
আমি জেনে-বুঝে পূজা করার মত তোমার পা স্পর্শ করতাম
কীভাবে তুমি মাথা নেড়ে হাসতে তা আমার মনে আছে
আমি ছাড়া যেহেতু তোমার আর কোনো প্রেমিক ছিল না
তাহলে সত্যি বলো, তোমার কি সেই মুহূর্তগুলো মনে আছে?
অন্যদের দৃষ্টি এড়িয়ে সবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে
তুমি লুকিয়ে রাতে আমার কাছে আসতে তা আমার মনে আছে।
আমাকে তোমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখলে তুমি কোমলভাবে
মিষ্টিকথায় আমাকে ভুলিয়ে তুমি নিজেই রাগ করতে তা আমার মনে আছে।
তুমি সবার চোখ এড়িয়ে যে জায়গায় আমার সঙ্গে মিলিত হতে
বহু বছর গত হলেও এখনও সে জায়গার কথা আমার মনে আছে।
হাসরত, তোমার সংযমের সকল দাবী সত্ত্বেও
আকাংখার ওই দিনগুলোর কথা এখনও আমার মনে আছে।
তিনি তাঁর অনেক কবিতায় রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকেও তুলে এনেছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। তাঁর একটি কবিতায় বলেছেন:
“আখোঁ মে নূর-ই-জলওয়া-ই-বে-কাইফ-ও-কাম হ্যায় খাস
জব সে নজর পে উনকি নিগাহ-ই-করম হ্যায় খাস,
কুচ হাম কো ভি আতা হো কি এ্যয় হযরত-ই-কৃষণ
ইকলিম-ই-ইশক আপ কে জের-ই কদম হ্যায় খাস
হাসরত কি ভি কুবুল হো মথুরা মেঁ হাজিরি
সুনতে হ্যায় আ’শিকোঁ পে তুমহারা করম হ্যায় খাস।”
অর্থ:
যখন সে তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টিতে আমার পানে তাকায়
আমার চোখ নামহীন বিশেষ আলোতে জ্বলে ওঠে।
শ্রদ্ধেয় কৃষ্ণ, আমার ওপরও কিছু বর্ষণ করে ধন্য করো,
কারণ তোমার পদতলেই বিরাজ করে প্রেমের সাম্রাজ্য
তুমি মথুরায় হাসরতের উপস্থিতিও গ্রহণ করে নাও,
শুনেছি, প্রেমিকদের প্রতি তোমার অনেক অনুগ্রহ।
তাঁর জীবনের এমন একটি পর্যায় ছিল যখন তাঁর প্রিয় প্রতীকে পরিণত হয়েছিল মক্কা, মথুরা ও মস্কো। জানা যায় যে তিনি এগারো বার হজ্ব করেছিলেন। পবিত্র স্থানগুলোর মধ্যে তিনি কোনো দ্বন্দ্ব দেখতেন না। যে ধার্মিক নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি মক্কায় গেছেন, একই ধরনের আন্তরিকতায় মথুরায় গিয়ে কৃষ্ণের শিক্ষা ও দর্শন থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন। মহাত্মা গান্ধীর প্রশংসা করলেও তাঁর কিছু আদর্শ ও পন্থাকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি গান্ধী ও লেনিনকে এভাবে তুলনা করেছেন:
“গান্ধী কি তরহ ব্যয়ঠ কে কাটেঙ্গে কিউঁ চরখা,
লেনিন কি তরহ দেঙ্গে না দুনিয়া কো হিলা হাম?
(গান্ধীর মতো চরকা কেটে সময় নষ্ট করছো কেন
কেন লেনিনের চেতনায় বিপ্লব সৃষ্টি করছো না?)
মাওলানা হাসরত মোহানি ১৯৫১ সালে লক্ষেèৗতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ও তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য ভারত ও পাকিস্তানে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ও রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে।