আমার ঘনিষ্ট পরিচিতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন কোভিড সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা লাভের আগে। তাদের মধ্যে শোয়েব নামে আমাদের পাড়ার একটা ছেলে ছিল। একই শহরে বাস করলেও তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিলনা। সর্বশেষ সাক্ষাতে তার বলা একটা কথা শুনে আমার খুব মনে ধরেছিল। সেটাই বলছি।
আমি জানতাম শোয়েব বৌ-এর সাথে বনিবনা না হওয়ার কারণে আলাদা থাকতো। বৌ খুব হুজুর টাইপের, তাই তার মানিয়ে চলতে কষ্ট হতো। এ নিয়ে তার অভিযোগ শুনে আমি মানিয়ে চলার চেষ্টা করতে পরামর্শ দিয়েছি। লাভ হয়নি। মৃত্যুর আগে সর্বশেষ যখন দেখা হয়, তখন আমি অবাক হয়েছিলাম তার বৌয়ের সাথে মিল হওয়ার কথা শুনে। সে বলেছিল, ‘কী হবে অশান্তি করে, তার চেয়ে মিটমাট করে নেওয়াই ভাল।’
নিঃসন্তান শোয়েব মানুষ হিসেবে খুব সহজ-সরল ছিল। মজার ব্যাপার ছিল, কোনো ওস্তাদের কাছে তালিম না নিয়েও জন্মগতভাবে সে ভাল পারকাশনিস্ট ছিল। তবলা, কঙ্গো, বঙ্গো, ট্রাম্বুরিন, মারাক্কাস সে একটু দেখলে বা শুনলেই বাজাতে পারতো। বয়সে সে আমার কিছু ছোট ছিল, তা সত্ত্বেও আমাদের কৈশোরে বা যৌবনের সূচনায় একসাথে সঙ্গীতের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অনেক সময় কাটিয়েছি।
আজ আমি যখন নিচে আপলোড করা গানের ভিডিওতে আমার কাহন-বাজানো দেখছিলাম, তখন পিছনে চেয়ারে ঝুলানো মাস্কটা দেখে আমার নজর থমকে গেলো। সাথে সাথে সামসময়িক অবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা জাগলো। মনে হলো, শোয়েব থাকলে কতো অনায়াসেই না এই কাহন বাদন শিখে ফেলতে পরতো! শোয়েব নেই, তাই মনের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
ভিডিওটা দেখছিলাম, আর ভাবছিলাম, মৃত্যুর আগে শোয়েব কী সুন্দর সহজভাবে তার দীর্ঘদিনের বিরোধটিকে মিটিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল একা একা। কিন্তু সবার বেলা ঘটনাচক্র কি একইভাবে কাজ করে?
আমি জানি, অন্তত আমারএক বন্ধুর বেলায় ঘটেছিল ঠিক তার উল্টোটা। এবার তাদের কথা একটু বলি।
আমরা তাদের খুব হ্যাপি কাপল বলে জানতাম। সদা হাসিখুশি, বাসাতে বন্ধুবান্ধব ডেকে হৈহুল্লোড়, স্বামী-স্ত্রী একসাথে বেড়াতে যাওয়া, হুট করে ফোন করে কারও বাসায় চলে যাওয়া, ঘটা করে জন্মদিন বা বিবাহবার্ষিকী পালন করা, কিংবা কখনও রেস্টুরেন্টে গিয়ে দলবেঁধে খাওয়াদাওয়া, আড্ডাবাজি করা। এইতো, গত বছরের মাঝামাঝি, যখন একটা সার্জারির কারণে স্বপ্নাকে (আমার স্ত্রী) বেশ কিছুদিন রান্নাঘর থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল, তখন এক সন্ধ্যায় তারা ফোন করে আমাদের বাসায় চলে এলো। সাথে মনে হয় পনেরো-কুড়ি পদের খাবার নিয়ে এলো, যার মধ্যে ভর্তা-ভাজি, মাছ-পোলাও-মাংস, পিঠা-পুলি সবই ছিল। আমাকে যাতে কয়েকদিন রান্না করতে না হয়, সেজন্যই এই ব্যবস্থা।
দুই-তিন সপ্তাহ আগে, আমার হঠাৎ মনে হলো, বেশ কিছুদিন হলো তারাও ফোন করেনি, আমিও না। সাথে সাথে ফোন তুলে কল দিলাম। সে বিস্তারিত কিছু বলেনি, তবে রবিবারে সামনাসামনি কিছু বলার জন্য সময় ও স্থান ঠিক করে নিলো। আমি প্রচণ্ড এক মানসিক চাপ নিয়ে সামনাসামনি হলাম। সেদিন বন্ধুটি নাটকীয়তা করে, হেসে হেসে, যথাসম্ভব রসালোভাবে কৌতুক করে বিষয়টাকে উপস্থাপন করেছিল এভাবে, ‘কিরে, রেডি আছসতো একটা বড় ধরনের দুর্ঘটনার খবর জানার জন্য?’
আমি জানি, বাইরের এই নাটকীয় আচরণ তার বেলায় স্বভাবজাত হলেও এবারের বিষয়টা কিন্তু অন্য রকম।
ঠিক তা-ই হলো। সেদিন সে যা বললো, তার জন্য আমি অবাক বা বাকরুদ্ধ হইনি, বরং যেন আকাশ থেকেই পড়লাম! এই সপ্তাহেই আইনিভাবে তাদের বিয়ের ভাঙন চূড়ান্ত হয়েছে। গাড়ি-বাড়িসহ সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা- কোনো কিছুই বাকি নেই। দুই যুগের বেশিকাল ধরে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা সম্পর্ক, এলবামে বেছে বছে তুলে রাখা পারিবারিক স্মৃতি, সব একদিনে একদম মিছে হয়ে গেল। অবাক করা সেই ঘটনাটি যখন আমাদের কমন বন্ধুদের সাথে শেয়ার করলাম, বন্ধুদের অনেকেরই আমাদের মতো রাতে ঘুমাতে কষ্ট হয়েছে!
এতোসব কিছুর মাঝেও প্রতিদিন সূর্য উঠে ও ডুবে। ফেসবুকে চলে সেলফি, লাইভ, ফেসটাইম, লাইক, শেয়ার, লাভ বাণিজ্য। আরও চলে অনলাইনে-অফলাইনে রাজনীতি, সঙ্গীত, কবিতা, সমাজ-গবেষণা, আড্ডা-আমোদ-ফুর্তি। করোনা যখন একটু সহনীয় পর্যায়ে, তখন আমরাও আবার জীবনকে ধরা-ছোঁয়ার মাঝে নিয়ে আসার জন্য মাঝে মাঝে মিলিত হই। কেউ গায়, কেউ বাজায়, কেউ শোনে। আর অন্যরা এসব ঘটনাগুলোকে নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে বিভিন্ন রঙ, কাঠামো ও আকৃতিতে, যদিও একই ঘটনার রঙ, কাঠামো, আকৃতি ভিন্ন হওয়ার কথা নয়!
শত দুঃখ-বেদনা আর তরঙ্গ-নিস্তরঙ্গের মাঝে চলমান জীবনের কিছু খণ্ডিত ক্ষণের প্রতিনিধিত্ব করে এই ছবিটি।