করোনা কেড়ে নিয়েছে অনেক প্রাণ, এই অনুজীবের প্রধান শিকার হয়েছে বেশি বয়সী মানুষেরা; এমনিতেও মারা গেছেন অনেক বয়স্ক মানুষ, যারা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাননি, করোনাকালে মারা গেছেন। এমনি একজন হলেন আমার রাষ্ট্রদূত বন্ধু মসয়ূদ মান্নানের শাশুড়ি মিসেস মুনীরা হক। করোনার কারণে যে বছরটি মহাকালে বৃহত্তম মহামারীর কলঙ্ক ধারণ করল, সেই ২০২০ সালের একেবারে শেষ দিনটিতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে গেলেন ৩৬ বছর ভিকারুননিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষকতা করা মানুষটি। তাঁর মেধাবী কন্যা ড. নুজহাত মান্নান মায়ের পেশাই বেছে নিয়েছিলেন, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। মগবাজারের গাউস নগরে মায়ের বাড়িতেই তিনি বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন, শৈশব কৈশোর যৌবন . সেই মা চলে গেছেন না-ফেরার দেশে, তাঁর স্মৃতিতে বিভিন্ন জনহিতকর সেবামূলক কাজ করছেন নুজহাত মান্নান। এরই একটি হলো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও কয়েকজন ব্যক্তিকে বারোটি হুইল চেয়ার সম্প্রদান। এই বারোটি হুইল চেয়ারের তিনটি প্রদান করা হয়েছে আহসানিয়া মিশনকে, তিনটি ফিরোজা বারী প্রতিবন্ধী শিশু হাসপাতালকে, চারটি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে, আর দুটি নিজের পায়ে হাঁটতে অসমর্থ দুজন দরিদ্র মানুষকে।
এই অনুদানে কৃতজ্ঞ আহসানিয়া মিশন নুজহাত মান্নান ও তাঁর স্বামীকে আমন্ত্রণ জানায় তাদের মিশন পরিদর্শনে, বিশেষ করে মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার হাঁসারা ইউনিয়নের আলমপুর গ্রামে মিশন পরিচালিত হাসপাতালটি দেখতে। এই কদিন আগেই উজবেকিস্তান ছেড়ে তুরস্কে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন মসয়ূদ মান্নান, শাশুড়ির মৃত্যুর কারণেই তার এ সময়ে দেশে আসা। কিন্তু যেদিন প্রোগ্রাম শ্রীনগরে আহসানিয়া মিশনে যাওয়ার সেদিনই মা যেখানে পড়াতেন সেই ভিকারুননিসা নুন স্কুলে নুজহাত মান্নানের উপস্থিত থাকা অনিবার্য হয়ে ওঠায় মসয়ূদ তার পুরনো বন্ধু কামরুল হাসান আর সাংবাদিক মাহমুদ হাফিজকে আমন্ত্রণ জানায় তার সফরসঙ্গী হতে। রাষ্ট্রদূতের আমন্ত্রণে শেষোক্ত দুজন ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিংয়ে পূর্ব নির্ধারিত ব্রেকফাস্ট আড্ডা বাতিল করে যোগ দেয় ঐতিহ্যবাহী বিক্রমপুর যাত্রায়।
গাউসনগরে এসে রিপোর্টিং করি। দেখি মাইক্রোবাস উড্ডয়নের জন্য টেকঅফ পয়েন্টে প্রস্তুত, কোপাইলটের সিটে স্বয়ং মসয়ূদ মান্নান। চতুর্থজন হলেন মুহম্মদ আনিসুল কবির জাসির। লম্বা নাম, মানুষটি দৈর্ঘ্যে প্রস্থেও বেশ ভারি। তার প্রথম পরিচয় সে আহসানিয়া মিশনের নিউ ইয়র্কের উপদেষ্টা, দ্বিতীয় পরিচয় সে মসয়ূদের ছোটো ভাই ডাক্তার পার্থের ছোটোবেলা থেকে বড়োবেলা পর্যন্ত বন্ধু। বিনয়ী মানুষটি দ্বিতীয় পরিচয়টিই প্রথম দিয়েছিলেন, ফলে আমরা ভেবেছিলাম তিনিও আমাদের দুজনের মতো অতিথি, এখন দেখছি তিনি আজকের এই ভ্রমণ কর্মসূচীর একজন পরিকল্পক। আহসানিয়া মিশনের জন্য তহবিল সংগ্রহ তার একটি প্রধান মিশন। হুইল চেয়ার তো আছেই, মান্যবর রাষ্ট্রদূতকে আমন্ত্রণ জানানোর মহৎ লক্ষ্য হলো ভ্রাতৃপ্রতীম রাষ্ট্র তুরস্ক থেকে আহসানিয়া মিশনের জন্য তহবিল আনায়ন।
মগবাজার থেকে ধানমন্ডি ৩১ নম্বর রোডে অবস্থিত আহসানিয়া মিশনের হেডকোয়ার্টারের দিকে যেতে যেতে জাসিরের গল্প শুনি। ছাত্রাবস্থা থেকেই সমাজসেবার ঝোঁক জাসির ও তার জানি দোস্ত পার্থের। নীলক্ষেত বস্তিতে তারা দুবন্ধু ছিন্নমূল শিশুদের জন্য একটি স্কুল চালাতো। সেই স্কুলের শিশুদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণের জন্য বই আনতো আহসানিয়া মিশন থেকে। ১৯৮৫ সালে দেখা পান আহসানউল্লাহর পরবর্তীতে যিনি মিশনটির দায়িত্বভার নিজ কাঁধে তুলে নেন সেই কাজী রফিকুল আলমের। দীর্ঘদেহী, ফর্সা আর নূরানী চেহারার মানুষটি প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ করেন, যতই দিন যায় ততই আবিস্কার করেন কাজী রফিকুল আলমের অন্তর সত্যিকার নূরে আলোকিত। কেবল ওই সততা ও সমাজসেবার দীপ্তি নয়, তিনি অসামান্য এক নেতা, যার কর্মদক্ষতা ও নেতৃত্বে আহসানিয়া মিশন বিপুল এক সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এ বছর এর বাজেট সাড়ে তিনশ কোটি টাকা। জাসির ও পার্থ লিও ক্লাব করতো, ১৯৮৯ সালে তারা মালয়েশিয়ায় বিশ্ব যুব সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল। পরের বছর জাসির তার আমেরিকায় চলে যায়।
খানবাহাদুর আহসানউল্লাহ আহসানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৩৫ সালে সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উজেলায়। তাঁর দানকৃত সম্পদ থেকেই গড়ে ওঠে সংগঠনটি, এই মহতী উদযোগের সাথে যুক্ত হন কিছু মহৎ হৃদয় মানুষ ।