মর্যাদাপূর্ণ একুশে পদক ২০২২ এ ভূষিত হলেন কবি কামাল চৌধুরী
রিপোর্টারের নাম :
/ ৩৮
ভিউ
আপডেট সময়:
শনিবার, ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২২
শেয়ার
মর্যাদাপূর্ণ একুশে পদক ২০২২ এ ভূষিত হলেন কবি কামাল চৌধুরী
যুবরাজ চৌধুরী
ড. কামাল চৌধুরী।
(পুরো নাম: কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী) একজন আধুনিক বাঙ্গালী কবি যিনি সত্তর দশকের সঙ্গে চিহ্নিত। চাকুরী সূত্রে তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন সদস্য হিসাবে সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসেবে গত ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে অবসর গ্রহণ করেন।
ড.কামাল চৌধুরী
একজন সুপরিচিত আধুনিক কবি।
তার কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু প্রেম ও দ্রোহ ;– সমাজচেতনা তার কাব্যপ্রেরণার অন্যতম সূত্র।
তার কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য গীতিময়তা। তার অন্যতম কাব্যগ্রন্থ টানাপোড়েনের দিন যাতে তিনি মুক্ত ছন্দে নতুন এক কাব্যভাষার অনুশীলন করেছেন।
কবি কামাল চৌধুরী বর্তমানে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি বাস্তবায়নের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
★জন্ম, শিক্ষা, কর্মজীবন
কামাল চৌধুরীর পুরো নাম ‘কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি কামাল চৌধুরীর জন্ম হয়েছিল কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিজয়করা গ্রামে।
বাবা আহমদ হোসেন চৌধুরী ও মা বেগম তাহেরা হোসেনের ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে নারায়ণগঞ্জের গোদনইল হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক (এস. এস. সি) এবং ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক (এইচ. এস. সি) পাশ করেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান অধ্যয়ন করেন এবং ব্যাচেলরস ও মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন ছিল উন্মাতাল; এখানেই কাব্যলক্ষ্মীর কাছে চিরসমর্পণ; এখানেই রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, তসলিমা নাসরিন সহ সমসাময়িক কবিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা; এখানেই কবিতার সঙ্গে চিরকালের গাঁটছড়া; এখানেই নিজেকে কবিতা পথিক হিসেবে চিরচিহ্নিত করা। কবিতা লিখতে লিখতেই এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন সমাজবিজ্ঞানে। কিন্তু সেখানেই লেখাপড়ার গণ্ডী শেষ হয়ে যায় নি। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি চাকুরীর অবসরেই নৃবিজ্ঞানে পিএইচ, ডি সম্পন্ন করেন। তার পি এইচ, ডি অভিসন্দর্ভের বিষয়বস্তু ‘গারো জনগোষ্ঠীর মাতৃসূত্রীয় আবাস প্রথা’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৮১’র বাংলা একাডেমী বই মেলাকে উপলক্ষ ক’রে একদল তরুণ কবি জীবনের প্রথম কাব্যগ্রন্ত প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন; কামাল চৌধুরী তাদেরই একজন। এ উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দ্রাবিড় প্রকাশনী। একুশের বইমেলাতেই বেরিয়েছিল কামাল চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ মিছিলের সমান বয়সী যাতে কবিতা ছিল ৪৮টি। কবিতাগুলো ভাষা ও শৈলী বলে দেয় শামসুর রাহমান তাকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে কামাল চৌধুরী বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন সদস্য হিসেবে চাকুরী গ্রহণ করেন। বিভিন্ন পদে চাকুরীর পর ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব থাকা কালে তিনি একই মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। পরবর্তীকালে কিছু সময়ের জন্য তথ্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ থেকে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দ তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর মার্চ ২০১৪ থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তাকে সরকারের সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতি প্রদান করা হয়।
তিনি বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন।২০১৭ সালে ৩১শে ডিসেম্বর তিনি অবসর গ্রহন করেন।
★ইউনেস্কোতে দায়িত্বপালন।
কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো নির্বাহী বোর্ডে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। এই নিযুক্তি ছিল ২০১৩-২০১৭ মেয়াদের জন্য। অধিকন্তু তিনি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে ইউনেস্কো নির্বাহী বোর্ডের ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন ২০১৩-২০১৫ মেয়াদের জন্য। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইউনেস্কোর নির্বাহী বোর্ডের কনভেনশনস অ্যান্ড রেকমেনডেশনস (সিআর) কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। ইউনেস্কোর পাঁচটি সাবসিডিয়ারি কমিটি রয়েছে যার মধ্যে সিআর কমিটির একটি। এর সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা বর্তমানে তিরিশ। কনভেনশনস অ্যান্ড রেকমেনডেশনস কমিটি বছরে দুইবার সভায় মিলিত হয়ে ইউনেস্কোর শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন সনদ ও সুপারিশ বাস্তবায়নে বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলো থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদনসমূহ মূল্যায়ন করে। একই সঙ্গে ইউনেস্কোর সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে। এ কমিটির দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে শিক্ষকদের মর্যাদা বিষয়ে আইএলও-ইউনেস্কোর যৌথ বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন ম্যূল্যায়ন করা।
★কবিতা স্বরূপ
তিনি ১৯৮০‘ দশকের প্রারম্ভে কবি হিসেবে আত্ম প্রকাশ করেন। তার কবিতায় সমসাময়িক প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। তার প্রথম গ্রন্থের নাম মিছিলের সমান বয়সী যার মধ্যে চিহ্নিত হয়েছে তার কবিসত্তার প্রধান প্রবণতা। তথাপি তিনি মূলতঃ গীতিকবিতায় সাবলিল। সমসাময়িক অন্যান্য কবিদের মতোই তার কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের যৌথ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তার “হাড়ের গল্প” নামক কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশের প্রভাব পড়েছে ছন্দে, শব্দচয়নে এবং বিষয়বিস্তারে এই ভাবেঃ
এই তো হাড়ের গল্প। আজ রাতে বিচ্ছিন্ন বধির
পরশ্রীকাতর মাংস এতদিন আঁঠাল স্বভাবে বেঁধে রেখে
আজ ফিরিয়ে নিয়েছে তার অন্ধমুখ।
অন্যদিকে ছন্দ এবং অন্তমিলে যে স্বাভাবিক দক্ষতা তার রয়েছে তা কখনো কখনো পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।
বিকেলের কথা মনে আছে ভাঁটফুল
বৃষ্টিতে ভিজে বেড়াতে যে এল কারা
পিছল রাস্তা কাদামাখা আঁকাবাঁকা
বেড়াবার সুখ দুর্ভোগে দিশেহারা।
মোহাম্মদ রফিক মন্তব্য করেছেন, “স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জনমানুষের বেদনামথিত উত্থান-পতনের ইতিহাস জানতে হলে আরো কারো কারো সঙ্গে অবশ্য পাঠ্য কামাল চৌধুরীর কবিতা। যে কোনো কবির পক্ষে এই এক বিরাট অর্জন।” তার মতে, “কামাল চৌধুরী রোমান্টিক ধারণার শেষতম প্রতিনিধিদের একজন। তবে তিনি ব্যতিক্রমী প্রতিনিধি। ব্যতিক্রমী এই কারণে যে, অনুভূতিকে নিজের ভেতরের আত্মস্থ করে নিয়ে ধারণ করে রক্তে-মাংসে-মজ্জায় তাকে দিতে পেরেছেন বস্তুর সংহতি। শব্দ উপমা ও চিত্রকল্পের যথাযথ সংযোজন মূর্ত হয়ে উঠেছে এক সংবেদনশীলতায়- যা একই সঙ্গে কবির নিজের এবং পাঠকেরও বটে। তখন তিনি পাঠক আর প্রতারকবন্ধু নয়, সে কবিরই কাব্যবিশ্বের একান্ত বাসিন্দা। এই সংযোগ বা সংহতি ধ্রুপদী কবিতার অন্যতম লক্ষণ। সরকার মাসুদ লিখেছেন, “কামাল চৌধুরীর কবিতা মিশ্র অনুভূতির জন্ম দেয়। তিনি প্রধানত রোমান্টিক আবার আধুনিকও। মূলত প্রথানুগ এই কবি কখনও কখনও প্রতাগত কাব্যের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা পেরেওছেন। ছন্দ তাঁর কবিতার এক উল্লেখখযোগ্য দিক। তবে বিশুদ্ধ গদ্যকেও তিনি অনেকবার ব্যবহার করেছেন। সেই গদ্য যখন সৃজনী মাত্রা অর্জন করেছে কেবল তখনই তা হয়ে উঠেছে ফলপ্রসূ।
★★প্রকাশনা
কামাল চৌধুরর প্রথম কাব্যগ্রন্থ মিছিলের সমান বয়সী প্রকাশিত হয় ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে। এরপর চাকুরী জীবনের ব্যস্ততা তাকে কবিতা থেকে কিছুটা দূরে ঠেলে দিয়েছিল। ১৯৮১খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত টানা নয় বছর কোনো কবিতার বই প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনি। এই বন্ধ্যাত্ব কেটে যায় ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে। এ বছর প্রকাশিত হয় কামাল চৌধুরীর দ্বিতীয় কবিতা-সংকলন টানাপোড়েনের দিন । অতঃপর একে একে আরো আটটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যথা:– এই পথ এই কোলাহল(১৯৯৩), এসেছি নিজের ভোরে(১৯৯৫), এই মেঘ বিদ্যুতে ভরা(১৯৯৭), ধূলি ও সাগর দৃশ্য(২০০০), রোদ বৃষ্টি অন্ত্যমিল(২০০৩), হে মাটি পৃথিবীপুত্র(২০০৬),প্রেমের কবিতা(২০০৮) এবং পান্থশালার ঘোড়া(২০১০)। উল্লেখ্য ১৯৯৫-এ তিনি প্রকাশ করেছেন একটি বাছাই সংকলন নির্বাচিত কবিতা । এরই ধারাই ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ করেছেন কবিতাসংকলন । এগারোটি গ্রন্থ থেকে তিন শত নয়টি কবিতা এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এছাড়াও কামাল চৌধুরী ২০০৭-এ প্রকাশ করেন কিশোর কবিতা সংকলন আপন মনের পাঠশালাতে। ১৯৯৫-এ আলী রীয়াজ-এর সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন সত্তর দশকের কবিদের কবিতা।
★*★পুরস্কার
১)রুদ্র পদক (২০০০)
২)সৌহার্দ্য সম্মাননা (পশ্চিমবঙ্গ) (২০০৩)
৩)কবিতালাপ সাহিত্য পুরস্কার (২০০৪)
৪)জীবনানন্দ পুরস্কার (২০০৮)
৫)সিটি- আনান্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (২০১০)
৬)দরিয়ানগর কবিতা সম্মাননা (২০১০)
৭)বাংলা একাডেমী পুরস্কার (২০১১)
৮)শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে প্রিয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৯
৯)একুশে পদক – ২০২২ ( ভাষা ও সাহিত্য)
সম্পাদক : মো: মশিউর রহমান মজুমদার ।
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: 37-20 73rd Street 1E, Jackson Heights, NY 10458।
মোবাইল : +1 415-850-7998 । ইমেইল : arthakantha@yahoo.com।