ফিনিক্স, অ্যারিজোনা। যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম বৃহত্তম শহর। জীবনের অর্ধেকের বেশী সময় ধরে এই শহরে আমার বাস। এই শহরেই আমার দুই মেয়ের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। এই মরু শহরের প্রতি কেমন যেন অন্যরকম একটা টান অনুভব করি। তাই চাকরির জন্য বিভিন্ন শহরে স্থানান্তর হলেও ফিনিক্স ছেড়ে চলে যাবার কথা কখনো ভাবিনি। এখনো দুই তিন সপ্তাহ বাইরের স্টেটে থেকে যখন ফিনিক্সে ফিরি মনে হয় যেন নিজ দেশে ফিরছি।
এ এক অন্যরকম কমিউনিটি। অন্যরকম কমিউনিটির মানুষগুলো। প্রায় পাঁচ হাজার বাঙ্গালির বাস এই বৃহত্তর ফিনিক্সে, তবে অন্যান্য শহরের মতো বাঙ্গালিদের মাঝে নেই কোন বড় ধরনের ঝামেলা। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফিনিক্স (বাপ) নামের একটি মাত্র সংগঠন এক বৃন্তে ধরে রেখেছে পুরো কমিউনিটিকে। আর এ সংগঠনের সাথেও আমার সম্পর্কটা বোধ হয় আত্মিক। ১৯৯৭ সালে সাংস্কৃতিক সম্পাদক, ১৯৯৮ সালে সাধারন সম্পাদক, ২০০১ থেকে ২০০৮ এবং ২০১১ থেকে ২০১৪ সভাপতির দায়িত্বে থাকাকালীন সময়ে এ শহরের মানুষগুলোকে খুব কাছে থেকে জানার সুযোগ পেয়েছি। আমরা আয়োজন করেছি অসংখ্য অনুষ্ঠান আর সহযোগিতা পেয়েছি সবার। ভুল যে করিনি তা নয়, তবে
গঠনমূলক সমালোচনার সাথে ছিল ভালবাসা আর আদরের পরশ। আর এ কারণেই হয়তো মনের অজান্তেই অ্যাসোসিয়েশন হয়ে উঠেছিল আমার আরেক সন্তানের মতো। আমাদের আগে যাঁরা এসেছিলেন অ্যাসোসিয়েশনে তাঁরা একটি কথাই বলতেন যে কমিউনিটিকে একসাথে ধরে রেখো যেমন ধরে রেখেছিলাম আমরা। চেষ্টা করেছি। এখনো এই শহরে কোন আঞ্চলিক সমিতি নেই, নেই বাংলাদেশী রাজনৈতিক দলের কোন অঙ্গ সংগঠন। এক নিজস্ব স্বকীয়তায় ফিনিক্স কমিউনিটিকে এখনো নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফিনিক্স।
অনেক বড় কমিউনিটি না হলেও বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এই কমিউনিটি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শহরের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে অনেক দূর। ২০০৪ সালে উত্তর আমেরিকা বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন, ২০১২ সালে AABEA সম্মেলন, ২০১৯ সালে বঙ্গমেলা আয়োজন ছাড়াও এখানে এসেছেন স্বনামধন্য অতিথি শিল্পীবৃন্দ। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, কবীর সুমন, রেজোয়ানা চৌধুরী বন্যা, পাপিয়া সারোয়ার, কাদেরী কিবরিয়া, রথীন্দ্রনাথ রায়, আবিদা সুলতানা, রফিকুল আলম, হৈমন্তী শুক্লা, অনুপ ঘোষাল, ফাতেমা তুজ জোহরা, হিমাংশু গোস্বামী, ফেরদৌস ওয়াহিদ, তাজুল ইমাম, দুলাল ভৌমিক, কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী, সামিনা চৌধুরী, ফাহমিদা নবী, আলমগীর, হাবিব ওয়াহিদ, নোবেল, মাইলস, এস, আই, টুটুল, জহির আলীম, ইমন চক্রবর্তী, শ্রেয়া গুহঠাকুরতা, বাবনা, খালেদ সুমন, আনীলা, কোজ-আপ ওয়ান তারকা নোলক, রাজীব, আবিদ, দীনা, ঋতুরাজ, অবন্তী সিঁথি, টুটুল, ছায়ানট বাংলাদেশ সহ আরো অনেকেই।
লেখকদের মধ্যে এসেছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, নবনীতা দেব সেন, ডঃ নুরুন্নবী। এম, এ, শোয়েব সঙ্গীত পরিবেশন করতে এসে নিজের ঠিকানাই বানিয়েছেন এ শহরকে। গত ঊনিশ বছর যাবৎ চলছে একটি বাংলা স্কুল। এছাড়াও গান ও নাটকের রয়েছে একাধিক দল। মুরাদ-রানা স্মৃতি টুর্নামেন্ট নামে চার থেকে সাতিটি দল নিয়ে ২০০৬ সাল থেকে প্রতি বছর চলছে কমিউনিটি ক্রিকেট। একঝাঁক নিবেদিত প্রাণ মানুষ স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে প্রতিদিন এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এ কমিউনিটিকে আর এই ফিনিক্স কমিউনিটি স্থান করে নিয়েছে উত্তর আমেরিকার এক ভিন্ন মাত্রার অনুসরনীয় কমিউনিটি হিসেবে।
প্রায় চল্লিশ বছরের ঐতিহ্য ভেঙ্গে এবারের একুশে ফেব্রুয়ারীর দু’টো অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে অনেকে আমার কাছে ইমেইলে বা ফোনে তাদের সংশয় প্রকাশ করেছেন যে তাহলে ফিনিক্সেও কি অন্যান্য শহরের বাংলাদেশী কমিউনিটির মতো অনৈক্যের বাঁশি বেজে উঠল? ফোবানার সাবেক চেয়ারম্যান এবং একযুগেরও বেশী প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অন্যান্য শহরের যে অবস্থা দেখেছি সেক্ষেত্রে মহান একুশকে নিয়ে দু’দিনে দু’টি অনুষ্ঠান হলেই আমাদের কমিউনিটি ভেঙ্গে যাবে আমি তা কখনোই বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করি না এজন্যেই যে ফিনিক্সের মানুষগুলোর উপর রয়েছে আমার পূর্ণ আস্থা। আমি আশা করি এই অনুষ্ঠান দু’টো শেষে আমরা সবাই মিলে ব্যক্তিগত মতবিরোধ ভুলে একটি সার্বজনীন অনুষ্ঠান আয়োজনে কাজ করব আর ফিনিক্স ফিরে পাবে এর পুরনো ঐতিহ্য ও সুনাম।