মশিউর আনন্দ, ঢাকা:
কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ৬৬টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে ‘নারী- পুরুষের সমতা, টেকসই আগামীর মূলকথা’ প্রতিপাদ্যের আলোকে ‘‘ নারীর প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধ করো, সম্পদ- সম্পত্তিতে সমান অধিকার ও সমঅংশীদারিত্ব নিশ্চিত করো’’- শ্লোগানকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন উপলক্ষ্যে সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম।সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাবেশ অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন নবনীতা চৌধুরী ও ছায়া কর্মকার । নৃত্য পরিবেশন করেন অংকিতা সাহা (শিশু শিল্পী) এবং আবৃতিসংগঠন পঞ্চকন্যার পাঁচজন আবৃতিশিল্পী শারমিন লাকি, তামান্না তিথি, নাজনীন নাজ, বুশরা তিথি এবং হাবিবা হ্যাপী আবৃতি পরিবেশন করেন ।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শেষে সমাবেশে ঘোষণা পাঠ করেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার রেহেনা বেগম। তিনি বলেন স্বাধীনতার ৫০ বছরে নারীর অবদানে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক খাতের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হলেও নারী ও কন্যাশিশুরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক সহিংসতাসহ বিভিন্ন দ্বন্দ্বের কারণে ধর্ষণসহ বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হচ্ছে। নারীর প্রতি এরূপ বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধ করে, সম্পদ- সম্পত্তিতে সমান অধিকার ও সমঅংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে তিনি এসময় কয়েকটি দাবি তুলে ধরেন।
১. সংবিধানে প্রদত্ত সমঅধিকার বাস্তবায়নের জন্য আইনগত পদক্ষেপে নিতে হবে এবং প্রতিষ্ঠানিক ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে।
২. সম্পদ- সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার ও সম অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
৩. নারী ও কন্যার প্রতি নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক আশ্রয়, প্রশ্রয় দেয়া বন্ধ করতে হবে। দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
৪. মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা অনুসারে ঘটনাস্থলকে মূখ্য বিবেচনা না করে ধর্ষণ, যৌননিপীড়ন এ ধরনের আমলযোগ্য অপরাধের ঘটনায় কোন বৈষম্য, বিলম্ব ছাড়াই তাৎক্ষনিকভাবে থানায় অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে হবে।
৫. অপরাধীকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। যৌননিপীড়ন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে পাড়া-মহল্লায় গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
৬. মাদকের ব্যবসা বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৭. ধর্ষণের মামলার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে।
৮. উত্ত্যক্তকরণ ও যৌননিপীড়ন বন্ধে মহামান্য হাইকোটর্ বিভাগের রায় বাস্তবায়ন ও রায়ের আলোকে আইন প্রণয়ন করতে হবে।
৯. পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রন আইন, ২০১২ এর বাস্তবায়ন করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নারীকে অবমাননা করে যে সব প্রতিবেদন প্রকাশ/প্রচার করা হয় তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
১০. ধর্ষণের শিকার নারীর ডাক্তারী (মেডিকো-লিগ্যাল) পরীক্ষার ক্ষেত্রে ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ নিষিদ্ধ করা মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বাস্তবায়ন করতে হবে।
১১. ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেয়া চলবেনা।
১২. অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সার্বিক নিরাপত্তা,অধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
১৩. করোনাকালীন ও করোনা পরবর্তী সময়কে বিবেচনায় নিয়ে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ আরও জোরদার করতে হবে।
১৪. বৈষম্যমূলক পারিবারিক আইন পরিবর্তন করে সকল নাগরিকের সমঅধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অভিন্ন পারিবারিক আইন চালু করতে হবে। (বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব, দত্তক, সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়সমূহ।)
১৫. নারী গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান এবং এ বিষয়টিকে শ্রম আইনে অর্ন্তভ’ক্ত করতে হবে।
১৬. গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি ২০১৫ পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
১৭. ২০১৩ সালের প্রতিবন্ধী অধিকার ও সুরক্ষা আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে।
১৮. ধর্ষণের শিকার বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী নারীর আইনগত সহায়তার ক্ষেত্রে ইশারা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
১৯. বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭-এর কন্যার বিয়ের বয়স সংক্রান্ত বিশেষ বিধান বাতিল করে আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে।
২০. জাতিসংঘের সিডও সনদের অনুচ্ছেদ-২ ও ১৬(১)(গ) এর উপর হতে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর প্রতি সকল প্রকার সহিংসতা দূর করে নারী পুরুষের সমতার দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই সমতা আমাদের এক নতুন সমাজ উপহার দিতে পারবে।
সমাবেশ শেষে একটি র্যালী অনুষ্ঠিত হয়। র্যালীটি শহীদ মিনার চত্বর থেকে শুরু হয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের টিএসসি তে সোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে গিয়ে শেষ হয়
উক্ত সমাবেশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির বিভিন্ন সদস্য সংগঠন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকসহ পাঁচশতাধিক জন উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন ঢাকা ওয়াই ডাব্লিউসিএ-এর উপাধ্যক্ষ ফ্লোরেন্স গোমেজ।