• রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৫:২৪ পূর্বাহ্ন

শিল্প বনাম অশ্লীলতা: প্রেক্ষাপট নারী নির্যাতন

Reporter Name / ১৩৩ Time View
Update : বুধবার, ৯ মার্চ, ২০২২

 

-ওয়াহিদা নূর আফজা
আচ্ছা শিল্প কী?
আপনি দ্য হুইসেলব্লোয়ার মুভিটি দেখেছেন? বসনিয়ার যুদ্ধ-পরবর্তী প্রেক্ষাপট নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছিল। সেখানে দেখি অল্পবয়সী মেয়েরা মানব পাচারের মাধ্যমে কিভাবে পতিতালয়ে আটকে যায়। শান্তিরক্ষার নামে জাতিসঙ্ঘের যে কর্মীরা সেসময় সেখানে কাজ করতেন, রাতের বেলা তারাই আবার হতেন ওদের ভোক্তা। হ্যাঁ, সেক্স বা যৌনতা ছবিটির একটি মূল উপজীব্য। তবে তার উপস্থাপন এমন ছিল যে আপনি ঐসব কিশোরী মেয়েদের মানুষ ভাববেন। অনুভব করবেন এ যুগের দাসবৃত্তি কতো ভয়ংকর হতে পারে! নিজের মেয়ে অথবা ছোট বোনটির দিকে তাকিয়ে একই সাথে আতঙ্ক আর আশ্বস্তির অনুভূতি আপনার মধ্যে প্রবাহিত হবে: ভাগ্যিস ওদেরকে এর মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে না।
কিন্তু নগর পুড়লে কী দেবালয় রক্ষা পায়?
এবার অশ্লীলতার প্রসঙ্গে আসি। রাস্তা দিয়ে যখন একটি মেয়ে হেঁটে যায় তখন তার দিকে তাকিয়ে যদি কেউ মাল শব্দটি ছুঁড়ে দেয় তবে তা অশ্লীলতা। বলিউড মুভির আইটেম গান যেখানে একজন নারী নিজেকে শুধুই ভোগ্যবস্তু হিসেবে তুলে ধরে তবে তাও হবে অশ্লীলতা। আবার দেলোয়ার হোসেন সাঈদী যখন তার ওয়াজে বয়ান দেন যে কমলা, কলা আর ললিপপ কত মূল্যাবান জিনিস, কেন এগুলো খোলসের মধ্যে আসছে – মূল্যাবান বলেই তো। অতএব নারী যদি খোলসের মধ্যে থাকে তো তার মূল্য বাড়বে।
আমার কাছে এসবও হচ্ছে অশ্লীলতার উদাহরণ। কেন? দেখুন এখানে মানুষকে তার মানবীয় অনুভূতিটুকু বাদ দিয়ে সম্পূর্ণভাবে একটি বস্তু, বা আরও বিশেষ ভাবে বলতে গেলে যৌনবস্তু হিসেবে দেখা হচ্ছে। আর মানুষ যখন বস্তু হয়ে পড়ে তখন তার সাথে ব্যবহারের মাত্রা যে কোন পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায়। আমরা টিভি সিরিয়াল রুটসে দেখি এই আমেরিকাতে সাদা মানুষরা কালো মানুষদের কিভাবে চাকুব মেরেছে। ইন্টারনেটে ফুটেজ পাওয়া যায় প্রায় গলা পর্যন্ত মাটিতে গেঁথে ফেলা মহিলাদের মাথা পাথর মেরে থেঁতলে ফেলা ছবি। এখন দেখছি সমুদ্রের বুকে ভাসমান নৌকায় শত শত কংকালসার মানুষের ছবি। তাদের অপরাধ নিজ দেশে কাজ নেই, কাজের অন্বেসনে তারা অন্য কোন দেশে যেতে চেয়েছিলেন। গরীবদের কেউ মানুষ ভাবে না। আর নারীদের অধিকাংশ তো গরীব না হয়ে গরীব, কিম্বা তার থেকে নিম্নতর – কলা, কমলা কিম্বা ললিপপ। আরেকটু যদি মিষ্টি কথা শুনতে চান তবে তারা আলমিরার লকারে ভরা হিরা-জহরত। কথা যাই হোক, ভাব কিন্তু ঐ একটাইঃ ওদের কোন অনুভূতির কোন মূল্য নেই, অতএব ওদের সাথে যা ইচ্ছা তাই করা যায়। আমার সংজ্ঞায় এটিই হচ্ছে অমানবিকটা, অশ্লীলতা।
অশ্লীলতা হচ্ছে অন্যায়, অবিচার আর অসাম্যের প্রবেশদ্বার। মানুষ সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধটুকু শুষে নেওয়ার ব্লটিং পেপার। তাই কারো ওড়না ধরে টান দেওয়াটা একটি অশ্লীলতা। কাউকে খোলসের মধ্যে ভরতে চাওয়াটা একটি অশ্লীলতা – অন্তত আমার কাছে। কারণ ঐ একটাই: নারীরা সব বস্তু, ভোগ্যবস্তু, যৌনবস্তু, তাদের নিজস্ব ব্যাক্তিত্ব বলে কিছু নেই। দাও কাপড় ধরে টান – তাদের সম্মান ধুলোয় মিটিয়ে যাবে, ভরো তাদের খোলসে অতিরিক্ত সম্মান উথলে উঠবে।
ছোটবেলায় একটি গল্পে পড়েছিলাম শেখ সাদি সাধাসিধা পোশাক পড়ে একটি মুসাফিরখানায় গিয়েছিলেন, খাতির পেলেন না। পরেরবার দামী পোশাক পড়ে গেলেন খুব সাদরে আপ্যায়িত হলেন। খানাপিনা উনি এরপর ঐ পোশাককেই করালেন।
হ্যাঁ, আমাদের নারীদের সম্মান-অসম্মান এখনও পোশাক রাজনীতির মধ্যেই আটকে আছে। তাই,
ওড়না ধরে মার টান
নারী হবে খান খান।।
পহেলা বৈশাখে রমনার কাছে যা হলো তা যে কালকে অন্য কোথাও ছড়িয়ে পড়বে না তার গ্যারান্টি কী? ঐ যে নগর পুড়লে দেবালয় রক্ষা পায় না। তবে প্রবাসে বসে আমার দেশের ভেতরেরর কথা লিখতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় বড্ড বেশি অনধিকার চর্চা করে ফেলছি। দেশের প্রতি যদি অতো ভালবাসা থাকতো তবে দেশেই থাকতাম। এ যুগের সবচেয়ে বড় মুক্তিযোদ্ধা হলেন তারা যারা দেশে আছেন। গত বছর বাংলাদেশে গিয়ে আমার এই উপলদ্ধি হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বান্ধবীর অফিসে গিয়েছিলাম। আইটি সেক্টরে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে সে। মাঝে মধ্যে সাপ্তাহিক ছুটিতে সে তার গ্রামে চলে যায়। এই যে সশরীরে গ্রামে চলে যাওয়া এটিই একটি বড় ধরণের মহৎ কাজ – অনেক অর্থ সাহায্যের থেকেও। হয়তো ওকে দেখে কোন এক বাবা তার মেয়েকে বলে উঠবে, ‘তোমার ঐ ফুপু কত বড় ইঞ্জিনিয়ার। একদিন তোমাকেও আমি ইঞ্জিনিয়ার বানাবো।’
ওর সামনে দাঁড়িয়ে আমার মনে হল সে অনেক বেশি একটি প্রয়োজনীয় জীবন কাটাচ্ছে। সে যে যে স্থানে উপস্থিত আছে, সেখানে সত্যিই তার প্রয়োজন আছে।
তাই সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের কিভাবে যুদ্ধ করতে হবে সে বিষয়ে উপদেশ না দিয়ে আমি বরং প্রবাসে আমার অভিজ্ঞতা বয়ান করি।
গত মাসে কাজের জায়গায় সেক্সুয়াল হ্যার‍্যাসমেন্টের উপর একটি ক্লাস করতে হল। প্রশিক্ষক বেশ সুন্দর করে যৌন হয়রানী বিষয়টি আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। এক মহিলা হিউম্যান রিসোর্সের কাছে অভিযোগ করলেন যে তার এক পুরুষ সহকর্মী প্রতিদিন ফুল পাঠিয়ে তাকে হয়রানী করছেন। তো হিউম্যান রিসোর্স সেই লোককে ডেকে কারণ দর্শাতে বললেন।
উত্তরে লোকটি বললেন, ‘ আমি আগে যখন ওকে ফুল পাঠাতাম, তখন তো ও বেশ খুশী হতো।’
‘আগে মানে কখন?’
‘ব্রেক-আপের আগে।’
তাহলে পাঠক বুঝে নেন, কোনটি হয়রানী আর কোনটি হয়রানী নয়। যৌন হয়রানীর বিষয়টি সাব্জেক্টিভ নয়, এটি পুরোপুরিই একটি অবজেক্টিভ বিষয়। তবে যে কোন যোগাযোগের প্রাথমিক শর্ত অনুযায়ী আমরা জানি যে অপর পক্ষের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চাইলে আগে একটি অনুরোধ পাঠিয়ে দিতে হয়। এরপর অপেক্ষার পালা। অপরদিক থেকে কোন সাড়াশব্দ না এসে আবার ভেবে বসবেন না যে বাঙালি নারী, বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। এটি একবিংশ শতাব্দী। বাইরের পৃথিবীতে নারীদেরও ফিফটি-ফিফটি অংশগ্রহণ থাকবে পৃথিবী এখন সে দিকে এগুচ্ছে। নারী হিসেবে আপনার দায়িত্ব হচ্ছে কোন মিথের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে করতে হবে নিজের ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার। ব্যাক্তিত্বের থেকে বড় পর্দা আর অন্য কিছু হতে পারে না। সম্মানের জন্য পোশাকের দ্বারস্থ হতে হলে, ঐ পোশাকে টান পরবেই। সম্মান কোন সস্তা বিষয় নয়।
আবার ফেরত আসি সেই সেক্সুয়াল হ্যার‍্যাসমেন্ট ক্লাসের প্রশিক্ষকের কথায়। ভদ্রলোক একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, ‘কেন এতো সেক্সুয়াল হ্যার‍্যাসমেণ্টের সমস্যা হচ্ছে?’
ক্লাসে বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। আমিও অধীর আগ্রহে বসে আছি এর উত্তর শোনার জন্য। আর ভাবছি ডারউইন, এক্স, ওয়াই দিয়ে তত্ত্বীয় কিছু যাতে না বলে। না, ভদ্রলোক সেদিকে গেলেন না। খুব সহজভাবে উত্তর দিলেন,
‘কারণ আমরা সেক্সুয়ালী অবসেসড প্রাণী।’
উত্তরটি খুবই সহজ এবং খুবই সত্য। এটি স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে কোন লজ্জা আছে বলে মনে করি না। যদিও রক্ষণশীল সমাজে আমাদের মেয়েদের এই ধারণা দেওয়া হয় যে আমরা যদি সেক্স না বুঝি তাহলে আমরা ভাল মেয়ে হতো পারবো। তাই এক জীবন আমাদের ঐ ভালো মেয়ে হতে হতেই কেটে যায়, আর মানুষ হওয়া হয়ে উঠে না।
আলোচনাটি শুরু করেছিলাম শিল্প আর অশ্লীলতার সংজ্ঞা খোঁজার মধ্য দিয়ে। আপাতত এই পর্বটি শেষ করবো সেই শিল্প আর অশ্লীলতার উদাহরণ দিয়ে। গুহাযুগে আদিম মানুষের দুটি অনুভূতি খুব প্রখর ছিল। এক, ক্ষুধা আরেক সেক্স। তখন মানুষ কাঁচা মাংসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাবলে হাবলে খেত। এখন আপনি দেখতে চান টেবিলে মশলাদার ভুনা মাংশ, পাশে একটি প্লেটে পরোটা, আরেক পাশে স্যালাদের বাঁটি। এটি একটি শিল্প। এই যুগে যদি আদিম মানুষের মতো করে খেতে চান তবে তা হবে অশ্লীলতা। ক্ষুধাকে শিল্পের আওতায় আনতে পারলে সেক্সকে নয় কেন? একটা মেয়েকে মাল বলা আর তার ওড়না ধরে টান দেওয়াটা কতো বড় অশ্লীলতা তা তো আমরা বুঝি, বুঝি না?
আমার তো মনে হয় সভ্যতা আর শিল্প সমার্থক নয়তো পরিপূরক। মানুষ হিসেবে আমি ততটাই সভ্য যতটা সভ্য আমি আমার অবসেশনকে করতে পেরেছি। আর তাছাড়া এই যুগে শুধু দুটো অনুভূতির মধ্যে মানুষ আর আটকে নেই। এখন হাজার হাজার অবসেশন চারপাশেঃ ফেসবুক, টুইটার, ব্লগ, ইউটিউব, কতো কী। জাপানে তো জনসংখ্যা কমতে শুরু করেছে।
নারীকে মানসিকভাবে দুর্বল করে কখনো ভাল ফল পাওয়া যায়নি। কারণ একজন দুর্বল নারী একজন দুর্বল সন্তানের মা হন। এই দুর্বল একজন ছেলে হতে পারে, মেয়ে হতে পারে। মাঝে মধ্যে মনে হয় আমরা অনর্থকই ছেলে আর মেয়ের বিতর্ক উত্থাপন করি। আসল বিতর্ক সভ্যতা আর অসভ্যতা, ভাল আর মন্দ, কিম্বা শিল্প বনাম অশ্লীলতার মধ্যে হলে ভাল হয়।
ওয়াশিংটন ডিসি,যুক্তরাষ্ট্র


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category