মেহেদী মাহমুদ চৌধুরী
যদি বলি অত্যুক্তি হবে না যে বাংলাতে গণিত বিষয়ে বই লেখাগুলো শিশু কিশোর পাঠক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগত গণ্ডির বাইরে যেতে পারেনি। কিন্তু গণিত যে একটা ভাষা পদ্ধতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরেও জানা ও ভাবার বিষয়, যা চিন্তা ও চর্চার বিষয় ও জগতকে নতুন করে দেখাতে পারে তা সম্পর্কে পাঠক ওয়াকিবহাল নয়। সত্যি যে বাংলাতে এরকম বই লেখা হয়নি যার নমুনার ভিত্তিতে পাঠক এ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়তে পারে। তাই গণিত মানে বাংলাতে এখন পর্যন্ত শিক্ষামূলক লেখা। গণিত যে মৌলিক চিন্তা ভাবনার একটা জায়গা হতে পারে সম্পর্কে অনেকে জানলেও মৌলিক কাজের দায়িত্ব তুলে রাখা হয়েছে দুঃখজনক ভাবে অপর ভাষার লেখকদের জন্য।
এই ভিত্তিতেই আমি আমার গণিত নিয়ে দুইটা বই সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে চাই। বইদুটি হলো “গণিত ভাবনা” ও “সাহিত্য ও গণিত”।
গণিত ভাবনা বইটা আমার দীর্ঘ দিনের গণিত বিষয়ে ভাবনার ফসল। নানা রকমের ভাবনাগুলোকে একসময় ভাষাতে রূপ থেকে গিয়ে তা লেখার সূচনা। পরে তাকে একসময় বই আকারে রূপ প্রদান। “গণিত ভাবনা”তে শিক্ষামূলক অনেক কিছু থাকলেও বইটার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে নানা বিষয় নিয়ে আমার নিজস্ব ভাবনা প্রকাশ। বইটার বেশ কিছু রিভিউ হলেও, এই জায়গাটা মোটামুটি নজর এড়িয়ে গেছে। বইটা আমার পরিচিত অনেকেই কিনেছেন ও পড়েছেন বলে জানি কিন্তু আমি মনে করি যে একটু ধীরে সময় নিয়ে পড়লেই ভালো ও আশা করি নানা ভাবে আমি যে মতামতগুলো প্রকাশ করেছি পাঠক সেগুলোকে নিয়ে আমার সাথে আলাপ করতে পারবেন। বইটা ২০২০ সালে বইমেলাতে সমাবেশ প্রকাশনী (পাঠক সমাবেশ) থেকে বের হয়েছিলো। বিদেশ থেকে বাংলাদেশে মেলার সময় বই বের করা বেশ কঠিন। দুঃখজনক ভাবে বইটাতে কিছুটা মুদ্রণ প্রমাদ রয়ে গেছে, যদিও তা পাঠে সমস্যা করে না। আশা করছি বইটার দ্বিতীয় মুদ্রণ খুব শীঘ্রই বের করা সম্ভব হবে।
অনেকেই জানেন যে এবারে বইমেলাতে আমার “সাহিত্য ও গণিত” শিরোনামে একটি বই চৈতন্য থেকে বের হয়েছে। এই বিষয়ে যেহেতু বই আগে লেখা হয়নি তাই ভেবেছিলাম লেখক সাহিত্যিকদের মধ্যে বইটা নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ থাকবে। বিস্ময়কর ভাবে তা ঘটেনি। এই বইটা আমার অনেক পরিশ্রমের ফসল। এরকম একটা বইয়ের ভাবনা আগে থাকলেও এই কঠিন কাজটা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেজ ভাইয়ের মৃত্যুর পরে তাকে উৎসর্গ করে বইটা লেখার সিদ্ধান্ত নেই ও পর পর কয়েকটা প্রবন্ধ লিখি। বইটা এখনও আমার হাতে আসেনি, তাই মুদ্রণের মান সম্পর্কে মন্তব্য করতে পারছি না।
বাংলাতে নতুন চিন্তা ও কাজ সম্পর্কে অনেকেই বলেন। কিন্তু কথা ও কাজে তাদের অনেক বেমিল। আমি মনে করি যে নতুন কাজ হচ্ছে কিন্তু তা অনুসন্ধানের যে চেষ্টা তার অভাব আছে, আর তা নজরে আসলেও তা তারা বুঝে উঠতে পারেন না। তাই সেগুলো হলেও মনোযোগ ও প্রচারের অভাবে তা হারিয়ে যায়। আমার বই ক্ষেত্রে তা হবে আমি চাইবো না, হবেও না বলে মনে করি, কারণ অনেকের নজরেই বইগুলো এসেছে, কিন্তু দুঃখজনক ভাবে এরকম পরিণতি অনেক বইয়ের ক্ষেত্রেই হচ্ছে। যারা নিজেদের চিন্তা, সাহিত্য ইত্যাদি জগতে বোদ্ধা মনে করেন, তাদের তাই এই প্রচারণার দায়িত্ব নেয়া উচিত। আমি যেহেতু দেশের বাইরে আছি তাই নিজে পক্ষে অনুসন্ধান চালানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু দেশে যারা আছেন ও এরকম নতুন কাজের খোঁজ করছেন বলে উল্লেখ করতে পছন্দ করেন, তাদের মধ্যেও সে প্রবণতা লক্ষ করিনি এই বইমেলা উপলক্ষে দেয়া পোষ্টগুলোতে।
আরেকটি সমস্যা হলো যা আমি পূর্বে অনেক বার উল্লেখ করেছি তা হলো পাঠের কোন ফলাফল না থাকা। নতুন বই হয়তো কেউ পড়ছে, পড়ে সে বইটা ভালো হয়েছে তা হয়তো বলেন, কিন্তু পাঠ তাকে বদল করে না। এজন্য সে ব্যক্তিটি যখন কিছু লিখে/বলে তখন, সে লেখাগুলোর কোন প্রভাব থাকে না ও নাম উল্লেখ করা হয় না। যেমন হয়েছে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু বিষয়ে। এই বিষয়ে এতো লিখা হয়েছে, কিন্তু যারা লিখেছেন তারা অপরের লেখা বা মতামত নিয়ে যে ভেবেছেন, তার নমুনা দেখা যায় না।
তবে সাম্প্রতিক কিছু বদল আমার চোখে পড়েছে। তা হলো রাষ্ট্র-সমাজ বিজ্ঞান বা রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিষয়ে বাংলাতে কিছু মৌলিক লেখার জন্ম হয়েছে যা সমকালের প্রভাব কম বেশী হলেও স্বীকার করেছে। সাবালকত্বের চেষ্টা লক্ষণীয় সেই কাজগুলোতে। গণিত ও বিজ্ঞান এখনো এদিক থেকে পিছিয়ে। যদিও এখানেও আমার পরিচিত কয়েকজন শিক্ষা মূলকতার বাইরে যাবার চেষ্টা করেছেন সাম্প্রতিক কিছু প্রকাশনাতে। কিন্তু আরো অনেক বাকি আছে সাবালকত্ব অর্জনের পথে।