• রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১২:২২ অপরাহ্ন

প্রতিদিন একবার করে নিজের সঙ্গে বিতর্ক করি দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে- আসিফ সালেহ

Reporter Name / ৭১ Time View
Update : শনিবার, ১৯ মার্চ, ২০২২

 

আসিফ সালেহ

বছরটা ২০০৬ সাল। আমি তখন লন্ডনে। প্রতিদিন একবার করে নিজের সঙ্গে বিতর্ক করি দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে। শুনলাম স্যার ফজলে হাসান আবেদ এসেছেন লন্ডনে। প্রবাসী বাংলাদেশীদের নিয়ে ছোট একটা অনুষ্ঠান হবে। গিয়ে হাজির হলাম। স্বভাবতই তাকে ঘিরে আছে সবাই। আমি এক ফাঁকে নিজের পরিচয় দিলাম। বললাম দেশে ফিরতে চাই। তা শুনে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে প্রশ্ন করা শুরু করলেন। অনেক মানুষের ভিড় সত্ত্বেও মনে হলো এ রুমে আমি আর তিনিই কথা বলছি। তাঁর পুরো মনোযোগ আমার প্রতি। কোথায় কাজ করি, কী করি, কোন কাজে দক্ষতা, কী চাওয়া-পাওয়া—সব শুনে বললেন তোমাদের মতো ছেলেরা যদি না আসে দেশ বদলাবে কী করে। অনেক কিছু করার আছে দেশে। স্যার ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যুর পর এবং এ ঘটনার ১৪ বছর পর অনেকেই যখন স্মৃতিচারণ করছিলেন তখন বুঝলাম যে তাঁর সঙ্গে এমন ছোট ছোট মুহূর্তের পরশপাথর আরো অনেকেরই আছে। মানুষের জীবনের দিক পরিবর্তনের জন্য মুহূর্তগুলো ছিল যথেষ্ট।

এ ঘটনার চার বছর পরই চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরলাম। নিজের একটি উদ্যোগ নিয়ে কাজ করার জন্য। উদ্যোগটি ছিল ছোট উদ্যোক্তাদের বাজারের সঙ্গে যুক্ত করে আরো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। কিছুটা ঝোঁকের মাথায় আমরা তিন বন্ধু দেশে ফিরলাম এ নতুন উদ্যোগ নিয়ে। আবারো কাকতালীয়ভাবে দেখা হলো আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে। বাংলাদেশে এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের একটি অনুষ্ঠানে আমাদের কোম্পানি চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রস্তাব পেশ করছে এবং তিনি প্রধান অতিথি। তিনি প্রতিটি কেস গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং তারপর প্রতিটি সম্পর্কে বিস্তারিত মন্তব্য দিলেন।

মন্তব্যগুলো কিন্তু কোনো ঢালাও, পৃষ্ঠপোষকতামূলক ছিল না। একেবারে প্রায়োগিক, চিন্তাপ্রসূত। মনে হলো ৫ মিনিটেই ধরে ফেলেছেন মূল ব্যাপারটা। দেখা করতে বললেন অনুষ্ঠান শেষে। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বাসায় ফিরলাম। তারপরে ই-মেইলে সাক্ষাতের অনুমতি চাওয়ার দুদিনের মধ্যেই তিনি সময় দিলেন।

আরো বিস্তারিত আলাপ করলেন। পাঠালেন ব্র্যাক ব্যাংকের রুমী আলীর কাছে, কীভাবে ব্যাংক আমাকে এ কাজে সাহায্য করতে পারে। আমার সামান্য এ উদ্যোগকে এত সিরিয়াসলি বাংলাদেশে তখন কেউ নেয়নি। পরে বুঝেছিলাম সামাজিক উদ্যোক্তাদের প্রতি তাঁর ছিল অন্য রকমের টান। সারা পৃথিবীজুড়ে তাঁর এমন অনেক উদ্যোক্তা ছিল যাদের জন্য তিনি অনেক সময় দিয়েছেন, মেন্টরিং করেছেন।

তার দু বছর পরে তাঁর ছেলে শামেরানের মাধ্যমে আবার যোগাযোগ। বললেন দেশের জন্য কাজ করতে চাইলে হাত ময়লা করতে হবে। মাঠে নামতে হবে। নীতি পর্যায়ের কাজ দিয়ে সেটা হবে না। তখন আমি জাতিসংঘে কাজ করছি। ততদিনে খুব একটা দ্বিতীয়বার চিন্তা করিনি। তাঁর সঙ্গে কাজ করার যে সুযোগ পেলাম, সেটা হেলায় হারাব না। সেই ব্র্যাক আমার জীবন বদলে দিল।

প্রথম দিনই বললেন ‘তুমি ব্র্যাকে লুকিয়ে থাকতে পারো, এত বড় সংগঠন—অনেক দিন কেউ কিছু বলবে না, আবার যদি সত্যি কিছু করতে চাও অনেক কিছু করতে পারবে। আমি এমন একটা সংগঠন তৈরির চেষ্টা করেছি, খাঁটি কাজের মানুষদের কাজ করার অনেক স্পেস দেয়। তুমি কী করবে এটা তোমার বিষয়।’

ব্র্যাকের কর্মজীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের কাছ থেকে শিখতে পারার সুযোগ। অফিসে প্রতিদিন আমি একটু দেরি করে থাকতাম। প্রায়ই সন্ধ্যায় ৬টা-৭টার পরে ফোন আসত—ফোনের চেয়ারপারসন লাল বাতি জ্বলে উঠত—বুকটা ধক করে উঠত। ‘আসিফ, একটু আসবে?’ ছুটে যেতাম। দুটো কাজের কথা বলে, তারপর গল্প শুরু করতেন। আশির দশকের গল্প, মানিকগঞ্জের গল্প, ওরস্যালাইন, এক রুম স্কুলে শিক্ষা। তাঁর স্বপ্ন, আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ। তাঁর কক্ষে যখন ঢুকতাম, তখন দেখতাম নিবিষ্ট মনে কিছু না কিছু পড়ছেন। বের হতাম যখন, তখন দেখতাম আবারো ফিরে গেছেন তাঁর জগতে। গভীর চিন্তার মগ্নতা আর তার সবকিছুর মূলে ছিল মানুষ আর সমাজ।

প্রথম দায়িত্ব নেয়ার পর আমাকে বলেছিলেন, ‘ব্র্যাক বুঝতে তোমার ছয় মাস লাগবে। এ সময়টা তুমি মাঠে যাও আর সত্যিকারের বোঝার চেষ্টা করো সংগঠনটিকে।’ মুখ ফুটে আর মুখ থেকে কাজের প্রশংসা শুনেছি বলে মনে পড়ে না। তবে তাঁর মুখ দেখে বুঝতাম কখন তিনি কাজগুলো পছন্দ করছেন। নতুন কিছু করতে চাইলে আমাকে বলতেন আর আমি দৌড়াতাম। দায়িত্ব ধীরে ধীরে বাড়ালেন। বুঝলাম আস্থা বাড়ছে ধীরে ধীরে। ২০১৯-এ আমাদের তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক যুক্তরাষ্ট্রে পরিবার নিয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে বোর্ডের অধীনে নতুন নির্বাহী পরিচালক খোঁজার কাজ শুরু হলো আন্তর্জাতিক একটি সার্চ ফার্মের মাধ্যমে। আমি একদিন দুরু দুরু বক্ষে তাঁর কক্ষে গিয়ে বললাম, আমি ভাবছি আমি আবেদন করব। তিনি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললেন, আই থিংক ইউ আর রেডি! ইউ শুড অ্যাপ্লাই। আবেদন করে সাক্ষাৎকার দিয়ে যখন অপেক্ষা করছি, তখনই এল তাঁর অসুখের দুঃসংবাদটি। তিনি তখন লন্ডনে। ফোনে কথা বললাম। আর এক মুহূর্ত থাকতে চাইছেন না সেখানে। দেশে চলে আসবেন। সুস্থ থাকতে থাকতে ব্র্যাকের বাকি কাজগুলো সেরে ফেলতে চান। আর কোনো চিকিৎসা নেবেন না ঠিক করে ফেলেছেন।

ফিরে আসার তিন সপ্তাহের মধ্যে সব গুছিয়ে ফেললেন। হাতে গোনা কিছু মানুষকে বললেন তাঁর অসুখের কথা। ব্র্যাক গুছিয়ে নতুন নেতাদের হাতে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে দেশ-বিদেশের বন্ধুদের চিঠি লিখে জানালেন তাঁর অসুখের কথা। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার বাড়িতে সাক্ষাৎ করে তাকে জানালেন। ব্র্যাকের শেষ বোর্ড মিটিংয়ের পরে রাতে এক নৈশভোজে জানালেন তাঁর পদত্যাগের কথা আরো কিছু পার্টনারকে। আর পরিচয় করিয়ে দিলেন নতুন নেতৃত্বকে। তারপরের দিন পরিবারের প্রায় ২৪ জন সদস্য নিয়ে চলে গেলেন থাইল্যান্ড। এক সপ্তাহ একটা ভিলাতে কাটল শেষ অবকাশ সবাইকে নিয়ে। দেশে ফিরে সব গুছিয়ে তিনি তৈরি তাঁর মহাপ্রস্থানের জন্য। যেমন তাঁর পরিকল্পনা ঠিক তেমনই তাঁর এক্সিকিউশন।

নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পেলাম এমনই এক অম্লমধুর অভিজ্ঞতায়। এরপর অফিস আসা বন্ধ করলেন। প্রথম প্রথম বাসা থেকে ঘন ঘন ফোন করতেন যখন যা মনে হতো তা নিয়ে। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কিছু করো। সিভিল সোসাইটি অ্যালায়েন্স করতে হবে। ইউনিভার্সিটির জন্য বড় আরেকটা ক্যাম্পাসের জায়গা দরকার। এ যেন এক অসামান্য কর্মবীরের, আরো অনেক না করা কাজের ফর্দ। কাজ শেষ করতে চাইছেন না, কিন্তু সময় শেষ হয়ে এল। তিনি চলে যাওয়ার তিন দিন আগে একদিন অফিস থেকে হাসপাতালে গেলাম দুপুরবেলায়। তিনি বেশির ভাগ সময় তখন ঘুমিয়ে থাকেন। জেগে থাকলেও একটা ঘোরের মধ্যে থাকেন মরফিনের প্রভাবের কারণে। সেদিন চোখ মেললেন।  আমি কাছে দাঁড়াতেই আমার হাতটা চেপে ধরলেন। স্মিত হেসে গভীর আবেগে আমার দিকে তাকালেন। কথা নেই, কিন্তু বুঝলাম এটাই বিদায়। আমিও শক্ত করে তাঁর হাত চেপে ধরলাম। আমার শিক্ষক, আমার গুরু এবং আমার হয়ে ওঠা বাবাকে চোখে চোখ রেখে শেষবারের মতো ধন্যবাদ দিলাম।

থাইল্যান্ডের শেষ অবকাশে তিনি প্রায়ই তাঁর সবচেয়ে পছন্দের কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাজাহান মুখস্থ আবৃত্তি করতেন। আজও যেন কানে বাজে তাঁর কণ্ঠে শোনা সেই কবিতার শেষ লাইনগুলো।

তুমি চলে গেছ দূরে

সেই বীজ অমর অংকুরে

উঠেছে অম্বরপানে।

কহিছে গম্ভীর গানে

যত দূর চাই, নাই, নাই সে পথিক নাই।

প্রিয়া তারে রাখিল না, রাজ্য তারে ছেড়ে দিল পথ

রুধিল না সমুদ্র পর্বত।

আজি তার পথ

চলিয়াছে রাত্রির আহ্বানে, নক্ষত্রের পানে।

তাই

স্মৃতিভারে আমি পড়ে আছি,

ভারমুক্ত সে এখানে নাই।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category