দুই:
একটি ঘোষণা আসবে বলে
কোটি বাঙালির সে কি ব্যাকুল
উন্মত্ত অপেক্ষা, টানটান উত্তেজনা
কখন আসবে, কখন আসবে
সেই কাঙ্ক্ষিত ঘোষণা। হাজার
বছরের বাঙালির ইতিহাসে কত নেতা
মানুষকে শুনিয়েছেন আশার বাণী;
দেখিয়েছেন বিনির্মাণের নতুন স্বপ্ন
নিজেদের বাগ্মিতায়, জাতীয় চেতনার
মাধ্যমে চেয়েছেন জনগনকে উদ্দীপ্ত করতে;
আহ্বান জানিয়েছেন জেগে ওঠার
চূড়ান্ত রায় দিয়েছেন জনগণের হাতে
কিন্তু বাঙালির স্বপ্ন পুরণ হয়নি।
তারপরেও হাল ছাড়েনি বাঙালিরা,
চোখে মুখে নতুন স্বপ্নের বুননে
ভাটা পড়েনি এতটুকু, আগ্রহের
এতটুকু কমতি হয়নি মানুষের।
অধীর আগ্রহে অপেক্ষায়
কোটি কোটি বাঙালি। যেন
কাংক্ষিত স্বাধীনতা না পাওয়া পর্যন্ত
ঘরে ফিরবেনা। একটি ঘোষণায়
আবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে
জেগে উঠবে আবার নতুন স্বপ্নে
সারাজীবন ধরে যে অধিকারের জন্য
অপেক্ষায়, আদায় করে নিবে
সেই কাংক্ষিত স্বাধীনতা।
তিন:
একটি ঘোষণা আসবে বলে
বাঙ্গালা থেকে বাঙালি আর বাংলার
জন্ম হয়েছিল। বাংলার মাটি আর
মানুষের সাথে জড়িয়ে সৃষ্টি হয়েছিল
ভাষাগত, বংশগত রাজনৈতিক ও
সাংস্কৃতিক পরিচয়। পুরা প্রস্তর যুগ থেকে
তাম্র যুগের সভ্যতা, বঙ্গ রাজ্য পুন্ড্র রাজ্য
থেকে মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তার। সম্রাট অশোক
থেকে গঙ্গারিডাই জাতির শৌর্যবীর্যের
কথা শুনে মহাবীর সিকান্দার তার
বিশ্ববিজয় অসম্পূর্ণ রেখে বিপাশার
পশ্চিম তীরে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।
প্রাচীন ইতিহাস থেকে সুলতানী আমল,
মোগল আমল থেকে পলাশীর প্রান্তরে
নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের পর
ইংরেজ দখল শোষন। শুরু হয়
বাঙালিদের ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, সৈয়দ
আহমেদ শহীদের তরিকা-ই-মুহম্মদিয়া আন্দোলন
তিতুমীর বাঁশের কেল্লা, দক্ষিণ-মধ্য বাংলায়
ফরায়েজি আন্দোলনে হাজী শরীয়তুল্লাহ থেকে
দুদু মিঞা, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ
চিত্তরঞ্জন দাস, সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়,
ঋষি অরবিন্দ ঘোষ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু,
রাসবিহারী বসু, ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী, সূর্য সেন
সহ কত বীর বিপ্লবী নেতা এল। কিন্তু বাঙালির
কাঙ্ক্ষিত সেই ঘোষণা বাঙালি পেলনা।
চার:
একটি ঘোষণা আসবে বলে
উনিশ শ বিশ সালের সতের মার্চ
গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় জন্ম নেয়
বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান
শেখ মুজিবুর রহমান। ধীরে ধীরে
বড় হতে থাকে শিশু খোকা। যতদিন যায়
ততই খোকা জড়িয়ে পড়ে বাংলা আর বাঙালির
স্বাধীকার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক হোসেন
শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মাওলানা ভাসানীর সান্নিধ্য
আর রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে রাজপথে খোকা
অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল। গ্রেফতার জুলুম
হাজতবাস হয়ে উঠে খোকার নিত্যদিনের ঠিকানা।
সাতচল্লিশের ভারত বিভাজনে মুসলিম প্রধান
পূর্ব ভাগ পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে পাকিস্তানের
অন্তর্গত হয়। শুরু হয় বাঙালির ভাষার আন্দোলন,
মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকারের আন্দোলন।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগানে আন্দোলনে বুক
পেতে দেয় বাঙালিরা, বুকের তাজা রক্তে
রঞ্জিত হয় রাজপথ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন,
ছেষট্টির ছয় দফা ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন
সত্তরের সাধারন নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ে
বাঙালির টুঁটি চেপে ধরে পশ্চিমারা। রাজপথ
জনপদ উত্তাল, জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত বাংলা
আর বাঙালি জাতি, অপেক্ষায় কোটি জনতা!
কখন আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত ঘোষণা।
পাঁচ:
একটি ঘোষণা আসবে বলে
টুঙ্গীপাড়ার খোকা স্বপ্ন দেখেছিল
বাংলার স্বাধীনতা, আর
বাঙালির মুক্তির। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন
করতে গিয়ে খোকা কারাগারে
নীত হয়েছেন, মুসলিম লীগের
দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার খোকা
বারবার জেলে গেছেন,
মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন,
কিন্তু তাঁর লক্ষ্য থেকে তিনি চ্যুত
হননি কখনো। আর এভাবেই
খোকা হয়ে উঠেছিলেন বাংলার
সবচেয়ে জনপ্রিয় আর অবিসংবাদিত নেতায়।
ষাটের দশকে পূর্ব বাংলার স্বাধিকারের
জন্য ছয় দফা উত্থাপন করে
চষে বেড়িয়েছেন সারা বাংলা,
হাজার বছরের সমস্ত বাঙালিকে একটি
মাত্র স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করেছেন,
একদেহ একপ্রাণ হয়ে উঠেছিল বাঙালি
আর একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে রণি উঠেছিল
বাঙালির প্রানে প্রানে আর গানে গানে
বীর বাঙালির জয় বাংলা
ধ্বনি কেঁপে উঠেছিল
পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর আস্তানা।
ছয়:
একটি ঘোষণা আসবে বলে
সত্তরের নির্বাচনের পর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী
ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করতে শুরু করে। পশ্চিমা
রাজনীতিবিদদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত
করে রাখার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল
ইয়াহিয়া খান মার্চে ডাকা জাতীয় পরিষদ অধিবেশন
অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করেন। এই সংবাদে
বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাঙালিরা। টুঙ্গীপাড়ার
সেই খোকা তখন বঙ্গবন্ধুতে পরিনত হয়েছে,
হাজার বছরের বাঙালি জাতি তাঁর পেছনে সমবেত,
তার নির্দেশ কার্যকর হচ্ছে সারা বাংলায়।
হরতাল অসহযোগ আন্দোলনে যখন উত্তাল সমগ্র পূর্ব বাংলা
ঠিক তখনই আসে ৭ই মার্চ। সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবির পর কালো কোট
পরিহিত বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন,
বাংলার বীর জনতা বজ্রনির্ঘোষে তুমুল
করতালি স্লোগানের মধ্যে তাঁকে
বীরোচিত অভিনন্দন জ্ঞাপন করে।
সর্বাত্মক মুক্তিসংগ্রামের অগ্নিশপথে ভাস্বর
যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত সভাস্থলের
প্রতিটি নিরস্ত্র মানুষ যেন সেদিন
সশস্ত্র হয়ে উঠেছিল, তাদের চোখমুখে শত্রুর বিরুদ্ধে
চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের অপার মহিমায় ছিল আলোকিত।
৭ই মার্চ লাখো জনসমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে
খোকা শুনায় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ বাণী
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সাত:
একটি ঘোষণা আসবে বলে
৭ই মার্চের পর বাঙালিরা সর্বাত্মক যুদ্ধের
প্রস্তুতি শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর বজ্রমন্ত্রে ধীরে ধীরে
বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মৃত্যুর কথা
ভুলে গিয়ে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতিতে নিতে শুরু করে,
চলে দফায় দফায় আলোচনা বৈঠক। কিন্তু কোন
আলোচনা বৈঠক কোন কিছুই যেন আর সফল হচ্ছিলনা।
মুজিবের নতিস্বীকার না করার সংকল্পের মধ্য দিয়েই আসে
২৫শে মার্চের ভয়াল কালোরাত! অপারেশন সার্চ লাইট দিয়ে
বাঙালি নিধন শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি।
বিশ্ব সভ্যতার এক কলংকজনক, জঘন্যতম গণহত্যার
সূচনা করে পাকিস্তানি সামরিকজান্তা।
গণহত্যার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যখন
প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে
যে ঘোষণাটি শুনবার জন্য অধীর উত্তেজনায়
আগ্রহে হাজার বছর ধরে বাঙালিরা ছিল অপেক্ষায়
ঠিক সেই ঘোষণাটি ২৬মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তান
রেডিওর সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ
থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’
শুরু হয় বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতার সশস্ত্র লড়াই
যার যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে দীর্ঘ
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ত্রিশ লক্ষ শহীদ
আর দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে
অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ‘
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্ব মানচিত্রে আর্বিভুত হয়।
– কথাসাহিত্যিক-সাংবাদিক, নীলগিরি, বান্দরবান।
– ২৬ মার্চ ২০২২ শনিবার, সর্বশেষ আপডেট ৩০ মার্চ বুধবার ২০২২