• রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৫:১৭ পূর্বাহ্ন

কথার কথকতা–মাইন উদ্দিন আহমেদ 

Reporter Name / ১২৩ Time View
Update : বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২

 

কথার কথকতা
– মাইন উদ্দিন আহমেদ 
রক্তের সম্পর্ক শক্ত না কি আত্মার সম্পর্ক শক্ত, এ প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। কোন সম্পর্কটি বেশি শক্ত, এ জিজ্ঞাসা প্রত্যেকটি সচেতন মানুষের। বিশেষ করে আত্মীয়স্বজন থেকে যাঁরা মনে, শরীরে বা আত্মায় আঘাতপ্রাপ্ত হন তাঁদের কাছেই প্রশ্নটি বেশি বড় হয়ে দেখা দেয়। যদিও বস্তুবাদি বা কঠোর বাস্তববাদি মানুষ বলবেন, স্বার্থের প্রশ্নে কোন সম্পর্কই দৃঢ় নয়, ভঙ্গুর। স্বার্থে আঘাত লাগলে রক্ত বা আত্মা কোন রজ্জুই আর সম্পর্কটাকে বেঁধে টিকিয়ে রাখতে পারেনা। তবে সাধারণ মানুষদের কাছে আত্মা ও রক্তের সম্পর্কের বিষয়গুলো এখনো জিজ্ঞাসা হয়ে দেখা দেয়। আমরা আজকের আলোচনাটি চিন্তা ও প্রজ্ঞার অতি উচ্চস্তরের মানুষদের জন্য করবোনা, আমার মতো সাধারণ স্তরের মানুষদের জন্য বোধগম্য হয় মতো করে এগিয়ে নেবো। আশা করি একটা উপসংহারে পৌঁছুতে পারবো আমরা।

আজ এ প্রসঙ্গে আমরা কথা বলবো মুগ্ধ এবং আমার সম্পর্ক নিয়ে। ফেইসবুকের বন্ধুরা এক সময় ওকে আমার ছেলে বা মেয়ের ঘরের নাতি মনে করতো। কিন্তু যখন দেখে যে, মুগ্ধ আমাকে ‘বড় আব্বা’ বলছে তখন অনেকেই জানতে চেয়েছে, সে আমার কি হয়? যারা জানতে চেয়েছে তাদেরকে জানিয়েছি, মুগ্ধ আমার ছোট ভাইয়ের ছেলে। এর বেশি কিছু বলার সুযোগ হয়নি। আজ  রক্তের বন্ধন ও আত্মার বাঁধন বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে সব কিছু খুলে বলবো। আমার পৈত্রিক বাড়ি দক্ষিণ বঙ্গে আর মুগ্ধর আব্বার বাড়ি উত্তরবঙ্গে, তাহলে আমরা দুজন কি করে ভাই হলাম! আসলে আমাদেরকে সত্যিকার অর্থে ভাই বানিয়েছে মুগ্ধ। আমি অসুস্থ হলে আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করার সময় কাগজপত্রে আমি হয়ে যাই মুগ্ধর আব্বার বড় ভাই। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াই আমরা ভাই হয়ে যাই। কি বিস্ময়কর ব্যাপার। মূল ঘটনাটি খুলে বলার আগে পটভূমিটা বিশ্লেষণ করা দরকার।
এর প্রাথমিক স্তরেই একটা সত্য প্রকাশ করা দরকার যে, ঢাকার মিরপুরস্থ মনিপুরে যে বাড়িটাকে সবাই সাংবাদিক মাইন উদ্দিন সাহেবের বাড়ি মনে করেন সেটি আসলে আমার নয়। এটির মালিক আমার বড় শ্যালক আর আমার শ্বাশুড়ী আম্মা। এটাতো আর মানুষকে ধরে ধরে বলার বিষয় নয়, প্রেস্টিজের ব্যাপারও আছে। বিশেষতঃ আমরা মানুষের বিশ্বাসে আঘাত হানতে চাইনি। কারণ বাড়ির মালিক হিসেবে ঈর্ষার চেয়ে প্রাপ্ত সমীহের পরিমানটা অনেক বেশি। আর আমরা এ পন্থা অবলম্বনের যুক্তি হলো এই যে, আমরা যে অংশে থাকি তার ইট-পাটকেল, টিন ইত্যাদি অর্থাৎ গৃহটি আমার খরচে বানানো আর নীতিগত শক্তি হলো এই যে, মায়ের অংশ থেকে আমার স্ত্রীতো জায়গা পাবেনই। যদিও এ প্রসঙ্গে আমার শ্বশুর সাহেবের নির্দেশনা সংশ্লিষ্টরা মানছেনা। বড়ির মালিক সেজে আমরা ইমেজটা ভোগ করতাম আর বিত্তসমূহ অর্থাৎ ভাড়ার টাকাটা তুলে গাঁইটের পয়সা থেকে রিক্সাভাড়া দিয়ে ওনার ভাইকে পৌঁছে দিয়ে আসতেন আমার সহধর্মিনী। এ কাজ এবং বাড়ি রক্ষনাবেক্ষণ-এর কঠিন দায়িত্বটি তিন দশক ধরে পালন করেছেন আমার স্ত্রী।
এবার চলে আসি আসল প্রসঙ্গে। মুগ্ধ কি করে আমার আব্বা হলো আর আমি কি করে ওর বড় আব্বা হলাম। মুগ্ধর আব্বা, আম্মা আর বড় ভাই থাকতো আমাদের বাড়িতেই। তখন মুগ্ধ পৃথিবীতে আসেনি।  বহু বছর পাশাপাশি অবস্থান। আমার স্ত্রী শিক্ষকতা করতেন তাই মুগ্ধর ভাই পড়বার সুবাদে পরিবারের ছেলের মতোই হয়ে উঠেছিলো।
মুগ্ধ পৃথিবীতে আসবে আসবে অবস্থায় ওর আব্বা তার মাকে নিয়ে ব্যস্ত। আজিমপুর ম্যাটার্নিটি থেকে যেদিন স্ত্রীকে নিয়ে বাসায় ফিরলেন আমাদের ‘মনা ভাই’ সেদিন ওনার স্ত্রীর কোলে ছিলো একটা ফুটফুটে ছেলে শিশু যার খালা তার নাম রেখেছিলো মুগ্ধ। আমার যমজ মেয়েরা ততদিনে পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষকতা করছে। মুগ্ধকে পেয়ে ওরাতো দারুণ খুশি। আমি স্বল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে এ বিষয়টিকে সমাজের আর দশটা শিশুর পৃথিবীতে আসার মতো সাধারণ ঘটনা হিসেবে নিয়েছিলাম। এরই মধ্যে ঘটলো আরেকটি ঘটনা।
আমেরিকা থেকে সপরিবারে দেশে এলেন আমার মেঝো ভায়রা। সবাই সেন্ট মার্টিনস যাবে বেড়াতে। আমার ম্যাডাম, ওনার দুই বোন, এই তিন পরিবারের সবাই পাঁচ দিনের ভ্রমণে চলে গেলো সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। যথারীতি চলছিলো লোনা পানিতে দাপাদাপি, উড়ন্ত মাছের ফ্রাই ভোজন, ঢেউ অবলোকন ইত্যাদি। তৃতীয় দিন ঢাকা থেকে একটা ফোন এলো যেটি আমাদের জন্য ব্যতিক্রমী একটা বার্তা নিয়ে এলো। ঐ ফোন কলের খবর আমার মধ্যে হঠাৎ একটা  অলৌকিক বাণী নিয়েই যেনো এলো।
আমার স্ত্রীর কাছে ফোন এলো, কাঁদো কাঁদো গলায় মুকুলের আম্মা ফোন করে প্রশ্ন করলেন, আপা আপনারা কবে আসবেন? মুকুলের আম্মা অর্থাৎ মুগ্ধর মায়ের করুণ করে আমার ম্যাডামতো ঘাবড়ে গেলেন, তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে মুকুলের মা, কোন বিপদ? উত্তর এলো, বিপদের চেয়েও বেশি, আপা, আমার ছোট ছেলে ঘুম থেকে উঠলেই হামাগুড়ি দিয়ে আপনার বাসার সামনে সিঁড়িতে উঠে দরজার দিকে চেয়ে থাকে, আপনাদেরকে খুঁজতে থাকে, আনতে গেলে কাঁদতে শুরু করে। এই ফোন পেয়ে, সারমর্ম শুনে আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সবার মধ্যে কেমন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা নীরিক্ষণের সুযোগ পাইনি কারণ এটি আমার মধ্যে এমন অনুভূতি সৃষ্টি করেছে যে, পারলে তখনি আমি ঢাকার দিকে রওয়ানা হয়ে যেতাম।
আমরা যতো দ্রুত সম্ভব ঢাকায় ফিরলাম। এরপর থেকে আমি মুগ্ধর হয়ে গেলাম এবং মুগ্ধ আমার হয়ে গেলো। প্রত্যেক দিন একবার ওকে নিয়ে ঘুরতে না বেরুলো আমার ভাত হজম হতোনা, ঘুম আসতোনা। আমার সাথে রিক্সায় মিরপুর দশ নম্বর না গেলে ওর ভালো লাগেনা। ছবি তোলাতো তসবীহ টেপার মতোই চলতে থাকে। এরই মধ্যে সে সেলফোন এমনভাবে কানে ধরতে লাগলো যে, মনে হয় কোন মাতব্বর অভিযোগ শুনছেন। আমার সাথে প্রেসক্লাবে পৌঁছে গেলো সে। ক্লাবের সামনের বাগানে সে ফুল টার্গেট করে এমনভাবে মোবাইল ফোন ধরে মনে হয় যেনো কোন প্রতিষ্ঠিত ফটোগ্রাফার। আমার মেয়েরা বলে, মুগ্ধ দেখি আপনার মতো করে হাঁটতে ও কথা বলতে চেষ্টা করে! চলছিলো সব নতুন গতিতে ভালোই কিন্তু বড় ধরণের ছন্দপতন হলো ওর প্রিয় ও অপরিহার্য তিনটি লোক আমেরিকা চলে আসাতে। আমি, ছোট ছেলে রিয়াজ আর ওর আম্মা, আমরা এ তিনজন চলে এলাম যা ছিলো মুগ্ধর কাছে একত্রে তিনটা বাজ পড়ার মতো। অনেক দিন সে সহজভাবে নিতেই পারেনি। আমার দু মেয়ে এবং ওদের জীবন সঙ্গীরা ওকে নতুন একটা মায়ায় গড়ে তোলার চেষ্টা করতে থাকে। তারপরও মাঝেমাঝে মেয়েদেরকে জিজ্ঞাসা করে, বড় আব্বা, বড় আম্মা আর রিয়াজ ভাইয়া কখন আসবে? সবাই উত্তর দেয়, করোনা কমলে, প্লেইন চললেই আসবে। এক পর্যায়ে ফোন করে ওর বড় আম্মাকে বললো, করোনাতো কমছে, প্লেইনতো চলে, তোমরা চলে আসোনা বড় আম্মা।
এরই মধ্যে জীবন নদীর পানি গড়িয়েছে অনেক দূর। মুগ্ধ বিখ্যাত মনিপুর স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ওর মা আর আমার মেয়েরা ওকে স্কুলে আনা-নেয়া করে। প্রায় প্রত্যহ আমরা ওর সাথে ফোনে কথা বলি।
এরই মধ্যে সে বুঝতে পেরেছে যে, রিয়াজ ভাইয়া অফিসে যায়, বড় আম্মা রিয়াজ ভাইয়াকে ভাত রেঁধে দেয়। বাংলাদেশে যখন দিন আমেরিকায় তখন রাত আবার দেশে যখন রাত ওখানে তখন দিন। মেয়েরা এবং ওদের হাজবেন্ডরা তাকে গুড হিউমারে রাখার চেষ্টা করে। এর মধ্যেও একদিন মুগ্ধ সবাইকে বললো, বড় আব্বার সাথে ফোনে কথা বলবো। খুব দরকার। আমাকে ফোনে ধরে কুশলাদি বিনিময়ের পর বলা হলো, মুগ্ধ আপনার সাথে কথা বলবে, খুবই নাকি দরকার। আমি ফোন ধরলাম, বললাম আব্বা তুমি কেমন আছো? মুগ্ধ বললো, বড় আব্বা এখনতো প্লেইন চলে, রিয়াজ ভাইয়া আর বড় আম্মা ওখানে থাক, তুমি চলে আসোনা, আমি তোমার সাথে দশ নম্বর যাবো, প্রেসক্লাব যাবো। আমি এতো আবেগায়িত হয়ে পড়েছি যে, একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারিনি। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার জীবনসঙ্গিনীর দিকে ফোনটা এগিয়ে দিলাম।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category