তানবীর সিদ্দিকী
দুটো ঘটনা। দুটোই প্যারিসের চার্লস দ্যা গল (Charles de Gaulle ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের। ২০১৯ এর নভেম্বরের মাঝামাঝি লাটভিয়ার রাজধানী রিগা’য় অল ইউরোপীয়ান বাংলাদেশ এসোসিয়েশন আয়েবার নির্বাহী কমিটির মিটিং। যাওয়ার কথা প্যারিস হয়ে। টিকিট করার সময় ট্রাভেল এজেন্ট জানতে চাইলেন ইংল্যান্ডের ভিসা আছে কিনা। আছে বলাতে তিনি বললেন তাহলে আপনি ঢাকা থেকে লন্ডন যান আর ফেরেন প্যারিস হয়ে। তাতে টিকিটের দাম কম পড়বে সাথে লন্ডনও যাওয়া হবে। লন্ডন থেকে প্যারিস বাস, ট্রেন বা প্লেনে যান। সেটাই করলাম। ও সময় একটু লম্বা সময় থাকলাম ইউরোপে। লন্ডন, প্যারিস, রিগা ছাড়াও অস্ট্রিয়া, সুইডেন, চেক রিপাবলিক, স্লোভাকিয়া চক্কর দিয়ে বন্ধুদের সাথে সুন্দর সময় কাটালাম কিছুদিন। সফরটা ছিল খুব আনন্দের।
বিভিন্ন দেশ ভ্রমনের সময় টুকটাক সুভেনীর আর গিফট কিনেছিলাম যেগুলো ডিউটি ফ্রি রিসিট দেয়। টাকাটা তারা নিয়ে নিয়েছে কিন্তু এয়ারপোর্টে রিফান্ড কাউন্টারে জিনিষসহ রিসিট দেখালে ডিউটির টাকা ফেরত দেয়। যে দেশ থেকেই জিনিষ কিনি না কেন এটা করতে হয় ইউরোপ ত্যাগের আগে শেষ বিমানবন্দরে। কাউন্টারটা থাকে ইমিগ্রশন এর বাইরে। এয়ারপোর্টে গিয়ে ওটা আগে করতে হয়। আমি চেকইন করে ইমিগ্রশন পার হওয়ার পর মনে হলো আমার কাছে রিফান্ড রিসিট আছে। প্রায় ৫০ ইউরো ফেরত পাবো। আমার জন্য অনেক টাকা সেটা।
ফিরে এসে ইমিগ্রশন অফিসারকে বললাম বিষয়টা। তিনি জানালেন তোমাকে নতুন করে ইমিগ্রেশন আর সিকিউরিটি পার হতে হবে। হাতে দুই ঘন্টার মতো সময় আছে। এদিকে ৫০ ইউরো পাওয়ার কথা। নিলাম একটা রিস্ক, বেরিয়ে এলাম ইমিগ্রেশন থেকে। আর বড় ভুলটাই তখন করেছিলাম। বাইরে রিফান্ড কাউন্টারে এসে দেখি লম্বা লাইন। জিনিষগুলো হ্যান্ড লাগেজের ছিল। ওই লাইনে দাঁড়ালে অনেক সময় লাগবে। ৫০ ইউরো নিয়ে নতুন করে ইমিগ্রশন পার হয়ে যেতে গেলে প্লেন মিস করার সম্ভাবনা আছে। ফিরে গেলাম ইমিগ্রশন এর লাইনে। বিশাল লম্বা সে লাইন। টেনশনে পড়লাম। সিকিউরিটির একজনকে বললাম আমার ইমিগ্রেশন করা আছে, আমাকে যেতে দাও। সোজা উত্তর তোমার সিরিয়াল আসলে তখনই তুমি কাউন্টারে যাবা। শেষ পর্যন্ত পার হলাম ইমিগ্রশন। একই কাউন্টারে পড়েছিল। মহিলা ইমিগ্রশন অফিসার পাসপোর্টে সীল দিতে গেলে বললাম তুমি আগে সিল দিয়েছ। আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি যাও!
দ্বিতীয়বার সিকিউরিটি ইমিগ্রশনে যাওয়ার পথে এসকেলেটরের কাছে এক বয়স্ক লোক ডাকলেন। অস্থিরভাবে পায়চারী করছিলেন। সাথে দুটো লাগেজ। দেখলেই প্যাসেন্জার মনে হবে। প্রথমবার ইমিগ্রেশনে যাওয়ার সময়ও তাকে দেখেছি ওখানে। কাছে যাওয়ার পর বললেন তিনি বিপদে পড়েছেন। ট্রেনে বার্লিন যাবেন কিন্তু কিছু টাকা কম পড়েছে। খুব অনুময় করলেন যে টাকাটা আমি দিলে তিনি অবশ্যই ফিরিয়ে দেবেন। সাথে টাকা নেই কিন্তু এয়ারপোর্টে এলেন কি করে, ক্রেডিট কার্ড কোথায় এসব নানান প্রশ্ন মাথায় আসলো। দেশে আমরা এমন সব কল্পকাহিনীর সাথে অভ্যস্ত। তারপরেও তাকে বিশ্বাস করতে চাইলাম। মানুষের বিপদ হতেই পারে। বললাম কত লাগবে। বললেন ২৫ ইউরো হলে তিনি বার্লিন যেতে পারবেন। বাকীটা উনার কাছে আছে। ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই জেনেও আমি বিশ্বাস করে ঠকতে চাইলাম। উনাকে ২৫ ইউরো আর কার্ডটা দিলাম। উনি আর কোনদিন আমার সাথে যোগাযোগ করেননি। কিন্তু শিক্ষাটা আমার দরকার ছিল।
গত ১ এপ্রিল প্যারিসের সেই চার্লস দ্যা গল এয়ারপোর্ট দিয়ে দেশে ফিরছি। কভিড সংক্রান্ত বিধিনিষেধ আর এমিরেটস এর বিশাল Airbus A380 প্লেনে চেক ইন করতে হবে বলে বেশ আগেই রওয়ানা দেই এয়ারপোর্টে। অনলাইন চেকইনের দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে এক ঘন্টার মধ্যে চেকইন হয়ে গেল। হাতে তখনো দুই ঘন্টা সময় আছে। কিছুক্ষনের জন্য গেটের বাইরে আসলাম। এ সময় এক ভদ্রলোক জানতে চাইলেন আমার কাছে অতিরিক্ত কোন খাবার আছে কিনা। উনার কাছে চাকা নেই খাবার কেনার। বললাম আমার কাছে কোন খাবার নেই। উনি আর কিছু বললেন না। কিছুক্ষন অপেক্ষা করলাম উনি টাকা চান কিনা দেখতে। আগের অভিজ্ঞতা মনে আছে। মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম যদি টাকা চান তবে ৫ বা ১০ ইউরো দেব। এয়ারপোর্টে খাওয়ার জন্য এটা অনেক। কিন্তু তিনি কোন অর্থ সাহায্য চাইলেন না!
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল, ২০২২