গোলাম মোর্তোজা
আখতারুজামান ইলিয়াসকে ঢাকা কলেজের করিডোর দিয়ে হাঁটতে দেখে শিহরিত হয়েছিলাম।তার ক্লাস করার সৌভাগ্য হয়নি।উচ্চ মাধ্যমিকের ক্লাস নিতেন না।তিনি নিতেন অনার্সের ক্লাস।অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আমাদের বাংলা পড়াতেন। তার ক্লাসে থাকত উপচে পড়া ভিড়।যদিও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা খুব একটা ক্লাস করত না।ছেলেদের কত যে কৌতুহল ছিল শামীম আজাদকে নিয়ে! তাকেও আমরা পেয়েছিলাম।
১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা কলেজ সত্যি এক ব্যতিক্রমী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তারকা শিক্ষক ছিলেন। সবচেয়ে ভালো শিক্ষার্থীরা উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হতো।বোর্ডে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করত।নিয়মিত ক্লাস হতো না।ক্লাস হলেও খুব কম সংখ্যক উপস্থিত থাকত।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা-ক্যাডাররা নিয়ম করে ঢাকা কলেজে আসতেন।ঢাকা কলেজের ছাত্রনেতা-ক্যাডারদের অবাধ বিচরণ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।ছাত্র রাজনীতি অস্ত্র-সন্ত্রাস,সবই ছিল ঢাকা কলেজে।এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল ঢাকা কলেজের।
সিটি কলেজের সঙ্গে অহেতুক কারণে মারামারি হতো।মার দেওয়াতে ঢাকা কলেজ সব সময় এগিয়ে থাকত।আশেপাশের রেস্টুরেন্টে ফাউ খাওয়া,জিন্সের প্যান্ট বা কেডস নিয়ে টাকা না দেওয়ার ঘটনা ঘটত।এমন কর্মকান্ড অল্প কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী করতেন।নিউ মার্কেটের দোকানদারদের সঙ্গে সমস্যা হতো।ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা মার দিত,খেত না।তবে সাধারণত ঘটনা বড় আকার নিত না।ছাত্রনেতারা মিটমাট করে দিতেন।চেইন অব কমান্ড ছিল।ছাত্র সংগঠনগুলোর সহ-অবস্থান ছিল।দল-মত ভিন্ন হলেও ছাত্রনেতা-কর্মীদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল অতুলনীয়।
তারকা শিক্ষকদের নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত ছিল।গল্প প্রচলিত ছিল ঢাকা কলেজের ছাত্রনেতা-ক্যাডারদের নিয়েও।একজন ছাত্রনেতা কাম ক্যাডার ঢাকা কলেজের পুকুরের সব পানি বিক্রি করে দিয়েছিলেন নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের কাছে।ভবন তৈরির জন্যে ব্যবসায়ীদের পানি দরকার ছিল।প্রেমিকাকে উপহার দেওয়ার জন্যে ছাত্রনেতার দরকার ছিল টাকা।পুকুরের পানি বিক্রির টাকা দিয়ে তিনি প্রেমিকাকে স্বর্ণের নেকলেস কিনে দিয়েছিলেন। এই গল্পে হয়ত কিছুটা অতিরঞ্জন থাকতে পারে,তবে অসত্য নয়। কত ঘটনা যে ঘটতো ঢাকা কলেজে!
ঢাকা কলেজে এখন তারকা শিক্ষক নেই।ভালো শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয় না।বোর্ড পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে না।ক্ষমতাসীনদের ছাত্র সংগঠন ৪-৫ গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নিজেরা নিজেরা রাজনীতি-সন্ত্রাস করে।ভাড়ায় মাস্তানি করতে যায়।নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এবারের সংঘর্ষের সূত্রপাত তেমন কিছু থেকেই।তবে বলে রাখা দরকার,নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীদের একটি অংশের ব্যবহার অসম্ভব খারাপ।শিক্ষার্থীরা ফাউ খায়, শুধু এই কারণেই বিরোধ তৈরি হয় না।ব্যবসায়ীদের খারাপ ব্যবহারও বিরোধ তৈরির অন্যতম কারণ।অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছোট বিরোধ বড় আকার ধারণ করে।কারণ ঢাকা কলেজের ছাত্ররাজনীতিতে এখন চেইন অব কমান্ড নেই।ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা এখন মার খায়।
ঢাকা কলেজ গৌরব হারিয়ে এখন ম্রিয়মাণ।প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে যা মেনে নিতে কষ্ট হয়।